in

সিরিয়ার বিদ্রোহী দ্রুজ নেতা কে এই হিকমত আল-হাজরি

সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী ও স্থানীয় যোদ্ধাদের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে যখন সিরিয়ার সুয়াইদা শহর অভ্যন্তরীণভাবে রক্তাক্ত হয়ে উঠছিল এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটছিল, তখন ইসরাইলি দখলদাররা দ্রুত সেই সুযোগটি কাজে লাগায়। যেকোনো ঔপনিবেশিক শক্তির মতো তারা আক্রমণকারীর ভঙ্গিতে নয়; বরং রক্ষকের সুরে হাজির হয়। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলের এক নিম্নবর্গীয় গোষ্ঠীকে রক্ষা করার অজুহাতে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়।

এই উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ইসরাইলি বাহিনী রাজধানী দামেস্কে হামলা চালায়। যেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দফতর ও প্রেসিডেন্ট ভবনের মতো সংবেদনশীল স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এই আগ্রাসন আন্তর্জাতিক নিন্দার মুখে পড়ে। তবে এটি সন্দেহজনকভাবে দ্রুজ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব শেখ হিকমত আল-হাজরির বক্তব্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়। তিনি সম্প্রতি সিরীয় সরকারকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করেছেন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর -যিনি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিকভাবে পলাতক- মতো বিদেশী নেতাদের সিরিয়ায় ‘দ্রুজদের রক্ষার জন্য’ হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন।

আধ্যাত্মিক নেতার ভূমিকাকে অতিক্রম করে এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত এই ধর্মযাজক সিরিয়ার রাজনৈতিক মঞ্চে বিভিন্ন সময় নানা ভূমিকা পালন করেছেন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আল-হাজরি এক অরৈখিক পথ অনুসরণ করেছেন। প্রথমে বিপ্লবের সময় নিরপেক্ষতা ঘোষণা, পরে আসাদ সরকারের প্রতি সমর্থন, এরপর নাগরিক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন, সর্বশেষে আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বাধীন আসাদ-পরবর্তী সরকারবিরোধী অবস্থান গ্রহণ। আজকের দিনে শেখ আল-হাজরি কেবল একজন ধর্মীয় নেতা নন; তার নাম এখন দ্রুজ সমাজ ও গোটা দেশের ভেতরেই একটি বিভাজন সৃষ্টিকারী উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হিকমত আল হাজারির প্রারম্ভিক জীবন

হিকমত সালমান আল-হাজরি ১৯৬৫ সালের ৯ জুন ভেনেজুয়েলায় জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তার পিতা কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সিরিয়ায় ফিরে এসে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি একটি রক্ষণশীল ধর্মীয় পরিবেশে বড় হন এবং দ্রুজ ধর্মের নীতিমালা ও শিক্ষার প্রতি গভীর আনুগত্য বজায় রাখেন। সম্প্রদায়ভিত্তিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার মাধ্যমে তিনি দ্রুজ আইনশাস্ত্র ও বিশ্বাসের বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। এই পটভূমিই তাকে তার সম্প্রদায়ে প্রভাবশালী ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।

১৯৯৩ সালে তিনি নিজের শহরে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৯৮ সালে আস-সুয়াইদা গভর্নরেটের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত নিজ শহর কানাওয়াতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে ১৯৮৫ সালে ভর্তি হয়ে ১৯৯০ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

হিকমত আল হাজারির ধর্মীয় নেতৃত্ব

২০১২ সালে ভাই আহমেদের মৃত্যুর পর হিকমত আল-হাজরি দ্রুজ সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এই পদটি তাদের পরিবারে উত্তরাধিকারসূত্রে হস্তান্তর হয়ে আসছে। আহমেদ ১৯৮৯ সালে পদটি গ্রহণ করেছিলেন।

জাবাল আল-আরব অঞ্চলের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধের কারণে আস-সুয়াইদার দ্রুজ আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠান দু’টি শাখায় বিভক্ত হয়। প্রথমটি কানাওয়াত শহরে আল-হাজরির নেতৃত্বে এবং দ্বিতীয়টি ‘আইন আল-জামান’ এলাকায় শেখ ইউসুফ জারবু ও শেখ হামুদ আল-হানাউইর নেতৃত্বে, যেখানে দ্রুজদের প্রধান উপাসনালয় অবস্থিত।

শেখদম গ্রহণের পর থেকেই হিকমত আল-হাজরি আসাদপন্থী অবস্থানের জন্য পরিচিত। জুসুর সেন্টার ফর স্টাডিজের ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘হাজরি সিরিয়ার সরকারের সাথে তার সারিবদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য অবস্থান নিয়েছেন।’ ২০১২ সালে বাশার আল-আসাদ কানাওয়াত শহরে এসে হিকমতের ভাই শেখ আহমেদ সালমান আল-হাজরির মৃত্যুর পর শোক প্রকাশ করেন। ওই সফরে হিকমত আল-হাজরি একটি ভাষণে আসাদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই সমবেদনা আনন্দে পরিণত হয়েছে। আপনিই আশা। আপনিই বাশার, আশা, বাশার, স্বদেশ, বাশার, আরব বিশ্ব। আল্লাহ আপনার জীবন দীর্ঘ করুন এবং আপনাকে পথ দেখান।’

গবেষণাটি আরো জানায় যে আল-হাজরি ইরাকি পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস (পিএমএফ)-এর প্রতিনিধিদের আতিথ্য করেছেন; ২০১৫ সালে তিনি সিরিয়ার সরকারকে দ্রুজ সম্প্রদায়কে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেন এবং প্রেসিডেন্ট ভবনের সাথে বহুবার মধ্যস্থতা করেন। ২০১৮ সালে আইসিস কর্তৃক ২৫ জন নারী ও কিশোরী অপহরণের ঘটনার পর তিনি দ্রুজদের সামরিক বাহিনীতে যোগদানের আহ্বান জানান। তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সমন্বয় করে একটি স্থানীয় সশস্ত্র দল গঠনের দায়িত্বও গ্রহণ করেন।

সরকারি বাহিনীর হাতে বিক্ষোভকারীদের নিহত হওয়ার বিষয় নিয়ে চুপ থাকার জন্য তিনি সম্প্রদায়ের ভেতর সমালোচনার মুখে পড়েন। তখন সুয়েইদায় বিক্ষোভ তীব্রতর হয়ে উঠেছিল, এমনকি বাশার আল-আসাদ ও তার পিতা হাফেজ আল-আসাদের মূর্তি ধ্বংস করার মতো ঘটনাও ঘটেছিল।

ফরাসি সংবাদপত্র ‘লিবারেশন’-এর এক প্রতিবেদনে ফ্রান্সপ্রবাসী সিরিয়ান সমাজবিজ্ঞানী ওমর আল-আসাদ বলেন, ‘২০১১ সালের বিদ্রোহের পর থেকে ধর্মীয় নেতারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন। আল-হাজরি কেবল দ্রুজ বন্দিদের মুক্তির জন্য বা সম্প্রদায়-সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের সাথে মধ্যস্থতার ভূমিকায় এগিয়ে এসেছেন।’

অন্যদিকে, জুসুর সেন্টারের তথ্যমতে, শেখ জারবু ও আল-হানাউই সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার কাজে বেশি মনোযোগী ছিলেন। তারা প্রায়ই একদিকে স্থানীয় উপগোষ্ঠী ও অন্যদিকে সিরিয়ার সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতেন। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি তারা বালুস পরিবারের নেতৃত্বাধীন ‘মর্যাদার পুরুষ’ আন্দোলনের সাথে পুনর্মিলন করেন, যারা সুয়েইদার বাসিন্দাদের সিরিয়ার সেনাবাহিনীতে নিয়োগের বিরোধিতা করেছিল। এই পদক্ষেপ তাদের স্থানীয়দের কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিতে অস্বীকৃতি জানালেও তারা শাসকগোষ্ঠীর সাথে সরাসরি সঙ্ঘাতে জড়াননি।

আল জাজিরার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিকমত আল-হাজরির অবস্থান তার ভাই আহমেদের অবস্থানের বিপরীত ছিল। আহমেদ ২০১১ সালে দ্রুজ সেনাদের সিরিয়ার সেনাবাহিনী ত্যাগের পক্ষে মত দিয়েছিলেন এবং অনেকে ফ্রি সিরিয়ান আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন। এই অবস্থানের কারণে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে ওই দুর্ঘটনাটি ছিল একটি পরিকল্পিত প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড। অনেকেই সেটিকে এক সতর্কবার্তা হিসেবে দেখেন, যা বিপ্লবপন্থী দ্রুজদের জন্য ছিল এক ধরনের হুঁশিয়ারি।

আল জাজিরা আরো জানায়, পূর্ববর্তী প্রতিবেদনগুলোতে দাবি করা হয়েছে যে আসাদ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আহমেদ আল-হাজরির উপর রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্যের ফতোয়া জারির জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিল। আহমেদ তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং সরকারের দেয়া যানবাহন ফিরিয়ে দেন, যা নিরাপত্তা বাহিনীকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। দুর্ঘটনার জন্য অনেকে নিরাপত্তা বাহিনীকেই দায়ী করেন, যদিও সরকার দাবি করে এটি একটি সাধারণ সড়ক দুর্ঘটনা ছিল।

জুসুর সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী, হিকমত আল-হাজরির সহকারী আবু ফখর -যিনি দ্রুজ গোয়েন্দা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ওয়াফিক নাসেরের সাথে সমন্বয় করেন- এবং নাজিহ জারবু, যিনি সুয়েইদার সামরিক নিরাপত্তা শাখার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, এই দলটির নেতৃত্বে ছিলেন।

আসাদ সরকারের প্রতি দীর্ঘদিন আনুগত্য প্রকাশের পর এবং বারবার সরকারের বিরোধিতা করতে বলা হলেও শেখ হিকমত আল-হিজরি ২০২১ সালে সুইদায় একজন বন্দীর ভাগ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে সিরিয়ার সামরিক গোয়েন্দা শাখার প্রধান লুয়ে আল-আলি কর্তৃক অপমানিত হন। এই ঘটনাই ছিল তার পিছিয়ে আসার মোড়বদল। দ্রুজ শেখদের মধ্যে আল-আলি ছিলেন সরকারের অন্যতম ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি।

দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের তথ্য অনুযায়ী, এই অপমানই আসাদ সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এরপর আল-হাজরির আচরণের বিরুদ্ধে জনরোষ দেখা দেয় এবং বিক্ষোভ শুরু হয়। তিনি এরপর এমন এক অবস্থান গ্রহণ করেন, যা সরাসরি গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

২০২২ সালের ১০ জুন আল-হিজরি সুইদার নিরাপত্তা শাখার প্রধানদের বরখাস্ত করার আহ্বান জানান এবং তাদের সমাজে বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ তোলেন।

যদিও সিরিয়ার বিপ্লবের সময় সুইদা তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল, মাঝে মাঝে সেখানে আসাদবিরোধী বিক্ষোভ দেখা গেছে। ২০২৩ সালের আগস্টে জ্বালানি ভর্তুকি প্রত্যাহার ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির প্রতিবাদে এমন এক বিক্ষোভে আসাদের পদত্যাগের দাবি ওঠে।

এই বিক্ষোভকে সমর্থনের পর শেখ হিকমত আল-হিজরির জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়, যদিও পূর্বে তিনি অতটা জনপ্রিয় ছিলেন না। ফরাসি সংবাদপত্র লিবারেশনের তথ্যানুযায়ী, তিনি পশ্চিমা কূটনীতিকদের সাথে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেন। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইথান গোল্ডরিচ ফোনে তার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। এই সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রে সিরিয়া-সম্পর্কিত বিভিন্ন অ্যাডভোকেসি গোষ্ঠী ও উভয় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের মধ্যেও প্রতিধ্বনিত হয়। তিনি ফরাসি ও ইউরোপীয় দূতদের সাথেও সাক্ষাৎ করেন।

সিরীয় গবেষক ওয়ায়েল আলওয়ান মন্তব্য করেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিকমত আল-হিজরি সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। আল-হানাউই ও আল-জারবুর তুলনায় অনেক বড় প্রভাব বিস্তার করেছেন।’ তবে বিপ্লবী ধারার অন্যতম নেতা ওয়াহিদ আল-বালাউসের সাথে তার সম্পর্ক উত্তপ্ত ছিল। এ থেকে বোঝা যায়, ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ ও নতুন বিপ্লবী উপাদানের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা বিদ্যমান ছিল।

আসাদের পতনের পর হিকমত আল হাজরি

বাশার আল-আসাদের পতনের পর আল-হিজরি আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের বিষয়ে নানা অবস্থান নেন। কখনো সমর্থন, কখনো বিরোধিতা, কখনো প্রত্যাখ্যান। তিনি সন্ত্রাসবাদ ও বিদেশী উস্কানির অভিযোগ তোলেন।

প্রথম দিকে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে সীমিত সহযোগিতার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং জাতীয় সেনাবাহিনী গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংবেদনশীল ইস্যুতে সমন্বয়ের কথা বলেন। তবে পরে তিনি নতুন সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন এবং সুইদায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেন। সরকারের সাথে সশস্ত্র সঙ্ঘাতে তার নাম জড়িয়ে পড়ে, যাকে তিনি সমর্থন করেন।

২০২৫ সালের মার্চে তিনি সিরিয়ার সরকারকে ‘চরমপন্থী ও ন্যায়বিচারবিমুখ’ বলে আখ্যায়িত করেন এবং বিদেশী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ‘নাগরিক রাষ্ট্র’ গঠনের আহ্বান জানান। তবে এই আহ্বান দেশজুড়ে সমালোচনার মুখে পড়ে। কারণ অনেকেই মনে করেন এটি বিভক্তির দাবি উস্কে দিতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে দ্রুজ সম্প্রদায়ের দুই প্রভাবশালী নেতা শেখ হামুদ আল-হানাউই ও শেখ ইউসুফ জারবু আল-হিজরির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন।

আশারকুল-আওসাতকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গবেষক ওয়ায়েল আলওয়ান জানান, আসাদবিরোধী অবস্থানের পাশাপাশি হিকমত আল-হিজরি ইসরাইলের দ্রুজ ধর্মীয় নেতা মুওয়াফফাক তারিফের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন। অপরদিকে, আল-বালাউস ও সুলেমান আব্দুলবাকী লেবাননের নেতা ওয়ালিদ জুম্বলাটের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন।

দখলদারিত্বের সাথে হাজরির সাক্ষাত

২০২৫ সালের ১৪ মার্চ ৫০ বছরের মধ্যে প্রথমবার ৬০ জন সিরীয় দ্রুজ ধর্মগুরু গোলান হাইটস অতিক্রম করে ইসরাইল প্রবেশ করেন। এজেন্সি ফ্রান্স-প্রেস জানায়, এই সফর হিকমত আল-হিজরি ও ইসরাইলের শেখ মুওয়াফফাক তারিফের সমন্বয়ের অংশ হিসেবে বাস্তবায়িত হয়, যা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়।

জারামানায় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে, আল-জুমহুরিয়া ডটনেট এক প্রতিবেদনে জানায়, শেখ হিকমত আল-হিজরির আত্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিনিধি খালদুন আল-হিজরি ওয়াশিংটনে মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তিনি সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস, উপকূলীয় আলাউই গোষ্ঠী এবং ইসরাইলের সমর্থনে সুইদায় সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন।

সাম্প্রতিক সঙ্কটে হিকমত আল-হিজরির ভূমিকা

বর্তমান সোয়েইদা সঙ্কটে হিকমত আল-হিজরির অবস্থান আএরা তীব্র হয়েছে। তিনি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার আহ্বান জানান এবং সিরীয় সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে উস্কে দেন। সম্প্রতি তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান, যিনি বর্তমানে গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিকভাবে অভিযুক্ত।

এই অবস্থান সিরিয়ার অভ্যন্তরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, বিশেষ করে যখন দামেস্কের প্রেসিডেন্ট ভবন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও জেনারেল স্টাফ ভবনের আশপাশে ইসরাইলি হামলা ঘটে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ দাবি করেন, দ্রুজদের সমর্থনে সুইদায় নতুন সঙ্ঘর্ষ শুরু হয়।

প্রথম দিকে হিকমত আল-হিজরি সরকার-ঘনিষ্ঠ বাহিনীর প্রবেশকে স্বাগত জানালেও পরে এক বিবৃতিতে বলেন, এটি দামেস্ক কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং প্রকৃত আলোচনা হয়নি। তিনি বলেন, এই অবস্থান ছিল আমাদের সন্তানদের রক্তপাত এড়াতে।

পরবর্তীতে তিনি সুইদায় সেনা প্রবেশে সমর্থন প্রত্যাহার করেন এবং জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আহ্বান জানান। তিনি সরকারকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বেসামরিকদের ওপর হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।

দ্রুজ নেতাদের মধ্যে শেখ ইউসুফ জারবু যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নিলেও আল-হিজরি তা প্রত্যাখ্যান করে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন।

পরিস্থিতি শান্ত করার সরকারি প্রচেষ্টার মধ্যেও হিকমত আল-হিজরি সুইদাকে ‘দুর্যোগ-পীড়িত শহর’ ঘোষণা করেন এবং উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় এসডিএফ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের আহ্বান জানান। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র কাঠামোর বাইরে এক নতুন যোগাযোগের দিক নির্দেশ করে। একইসাথে জানা গেছে, তার ঘনিষ্ঠ বাহিনী শহরে কারফিউ জারি করেছে।

আরো গুরুতর কিছু ঘটনার মধ্যে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, হিকমত আল-হাজরির সাথে সম্পৃক্ত নিষিদ্ধ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো শহর ছাড়ার জন্য একটি নির্ধারিত সময়সীমা দেয়ার পর বেদুইন পরিবারগুলোকে বাস্তুচ্যুত করেছে।

এদিকে, আশরাকুল-আওসাত পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস তাদের পরিচালকের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে ওই এলাকায় ১৪ জন উপজাতি সদস্যকে হত্যার ঘটনা তারা নথিভুক্ত করেছে।

একই প্রেক্ষাপটে, সরকারি সংবাদ সংস্থা সানা স্থানীয় সূত্রের বরাতে জানিয়েছে, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সুয়েইদার আল-মাকুস পাড়ায় হামলা চালিয়ে উপজাতি ও বেদুইন জনগোষ্ঠীর নারী ও শিশুদের লক্ষ্য করে গণহত্যা এবং মাঠপর্যায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরসহ বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের লঙ্ঘন করেছে।

সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, এতে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে, যা অঞ্চলটিতে ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলার বাস্তবতা এবং একাধিক গোষ্ঠীর -যারা স্থানীয় জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব দাবি করে অথবা বাইরের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে নিজেদের বাস্তবতা চাপিয়ে দিতে চায়- মধ্যে সঙ্ঘাতের প্রতিফলন।

This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!

Report

What do you think?

Written by Sultana

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

GIPHY App Key not set. Please check settings

Loading…

0

১৩ দিনে এলো ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি রেমিট্যান্স