in

সহিংসতায় ছাত্রলীগ মদদদাতা নওফেল!

চট্টগ্রামে আইনজীবী আলিফ হত্যায় গ্রেফতার ২৮ ভিডিও ফুটেজে শনাক্ত খুনিচক্রের সদস্যরা একজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার!

চট্টগ্রামে ইসকনের বেশে হত্যা সহিংসতায় নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী। তাদের টার্গেট ছিল দেশে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো।

ভিডিও ফুটেজ দেখে খুনিচক্রের সদস্য বেশ কয়েকজন ক্যাডারকে শনাক্ত করা হয়েছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার ২৮ জনের মধ্যে কয়েকজন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মী রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন নগর পুলিশের কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে পুরো ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন বিদেশে পলাতক পতিত স্বৈরাচারি হাসিনা সরকারের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী স্বঘোষিত ইসকন সদস্য মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। পালিয়ে থাকা তার সাবেক একান্ত সচিব অমিত কুমার বসু, কুখ্যাত যুবলীগ ক্যাডার নুরুল আজিম রনি খুনি চক্রের সদস্যদের সাথে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে পুরো সহিংসতার মদত দিয়ে গেছেন। এছাড়া চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণ ও আশপাশের এলাকায় নজিরবিহীন ওই সহিংসতায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারী কতিপয় উগ্রবাদী ইসকন সদস্য, ইসকন সমর্থক কিছু আইনজীবী ও তাদের ক্লার্কদের জড়িত থাকারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এরমধ্যে হত্যাকা-ে জড়িত শ্রী শুভকান্তি দাস নামে এক ছাত্রলীগ ক্যাডারকে বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছে চট্টগ্রামের বেসরকারি বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সহিংসতায় জড়িতদের ছবি প্রকাশ করেছেন। নগরীর পাহাড়তলী থেকে নাশকতার উদ্দেশে জড়ো হওয়া নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ছয় ক্যাডারকে ককটেলসহ পাকড়াও করা হয়েছে।

পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব এক গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠে পতিত স্বৈরাচারের দোসরেরা। বিগত কয়েক মাসে তারা ভিন্ন ভিন্ন বেশে রাস্তায় নেমে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। মূলত জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে হামলা ও গুলিবর্ষণে জড়িত নওফেলের ক্যাডারেরা মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠে। গণঅভ্যুত্থান দমনে যারা রাজপথে সহিংসতায় মেতে উঠেছিল তারাই এখন বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল করতে মাঠে নেমে পড়েছে। তাদের প্রভুরাষ্ট্র ভারতের নীলনকশা অনুযায়ী চট্টগ্রামে একের পর এক সংঘাত সহিংসতা, নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে এ চক্রটি। এতে অর্থের জোগান দিচ্ছেন বিগত লুটেরা ও ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলের সুবিধাভোগীরা। তাদের মূল টার্গেট চট্টগ্রাম থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি।

এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি ইসকন থেকে বিতাড়িত বিতর্কিত হিন্দু নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে আদালতে হাজির করার ঘটনাকে ঘিরে ভয়ঙ্কর নাশকতায় মেতে উঠে এ চক্রটি। আইনজীবী আলিফকে কুপিয়ে হত্যার পাশাপাশি তাদের সহিংসতায় ১০ পুলিশ সদস্যসহ ৩৫ জন আহত হয়েছেন। উগ্রবাদীদের হামলায় আদালত থেকে শুরু করে আদালত এলাকার মসজিদ, দোকানপাট, যানবাহন ভাঙচুরও হয়েছে। তারা অনেকটা গায়ে পড়ে সংঘাতে জড়ানোর অপচেষ্টা চালায়।

তবে চট্টগ্রাম আদালতের সচেতন আইনজীবী ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপে বড় ধরনের সহিংসতা থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। তবে চিন্ময়ের অন্ধ সমর্থক উগ্রবাদী কতিপয় ইসকন সদস্যের এসব অপকর্মের সাথে সাধারণ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা বলছেন, এসব উগ্রবাদী গোষ্ঠী একটি রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল হয়ে পুরো সম্প্রদায়কে সন্দেহের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে প্রকাশ্যে দিনের আলোতে শত শত মানুষের সামনে কুপিয়ে হত্যার নেপথ্যে রয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ক্যাডারেরা। ওই দিনের ঘটনার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বিকেলে আইনজীবী আলিফ আদালত ভবনের প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে বেরিয়ে সড়কের উল্টোপাশে মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় তিনিসহ আরো ১০-১২ জন আইনজীবীকে জয় শ্রীরাম সেøাগান দিয়ে ধাওয়া করা হয়। এ সময় তিনি পা পিছলে পড়ে যান। এ পর্যায়ে ধারালো অস্ত্রধারী ১০-১৫ জনের একদল যুবক রঙ্গম কমিউনিটি সেন্টারের সামনে প্রথমে কুপিয়ে তারপর মাথা থেতলে দেয়। এরপর আরেক দল কুপিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। ওই ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত সাতজনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।

তারা হলেন- বিজিবি ট্রাস্ট বিশ^বিদ্যালয়ের এলএলবির ৩৬তম ব্যাচের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শুভকান্তি দাস। নগরীর মেথরপট্টি এলাকার টিভি চোর সুমন নন্দী, হাজারি গলির মৃত মনোরঞ্জন দে’র ছেলে বিকাশ দে, জলসা মার্কেট এলাকার মৃত সুধীর চক্রবর্তীর ছেলে নারায়ন চক্রবর্তী ও বন্দর নিমতলা এলাকার মানিক দে’র ছেলে মন্টু দে।

দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাহেরের অনুসারী শিপিং কোম্পানীতে চাকরিরত রাজীব ভট্টাচার্য, বাকলিয়া কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি জিয়াউদ্দিন ফাহিমও হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল বলে নিশ্চিত হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন, চিন্ময়কে আদালতে হাজির করাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের সহিংসতার প্রমাণ করে পতিত সরকারের দোসরেরা। এ লক্ষ্যে হোয়াটঅ্যাপ গ্রুপে সার্বক্ষণিক নির্দেশনা দেন সন্ত্রাসী নরুল আজিম রনি। ক্যাডারদের সংগঠিত করেন নওফেলের সাবেক পিএস অমিত কুমার বসু। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হওয়ার সুবাদে নওফেলের পিএস হন অমিত কুমার। মূলত তখন থেকেই চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের ভয়ঙ্কর ক্যাডারদের সংগঠিত করেন অমিত।
জুলাই বিপ্লবে নগরজুড়ে যে সহিংসতা ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় তার মূল সমন্বয়কারী ছিলেন নওফেলের এই অন্যতম সহযোগী। এই সন্ত্রাসী প্রভাব খাটিয়ে অযোগ্য হওয়ার পরও তার স্ত্রীকে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাইয়ে দেন। নওফেল পালিয়ে গেলেও অমিত চট্টগ্রামে অবস্থান করে সব অপকর্ম পরিচালনা করছেন।

নগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের টার্গেট ছিল আদালত ভবনে সহিংসতা করে বিচারকদের মারধর করা। এরপর ইসলামী দল কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কোনো মিছিল হলে সেখানে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালানোরও পরিকল্পনা করে ওই খুনিচক্র। সন্ত্রাসী রনির সাথে ঘটনার সময় আদালত প্রাঙ্গণে থাকা কয়েকজন ছাত্রলীগ ক্যাডারের হোয়াটঅ্যাপের তথ্য আদান প্রদানের স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এই অপকর্মে অর্থ সরবরাহকারীদের মধ্যে অরবিন্দ ধর বসু নামে একজনের পরিচয়ও নিশ্চিত করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
নগর পুলিশের এডিসি (গণমাধ্যম) কাজী তারেক আজিজ জানান, হত্যাকা-ে জড়িত সাত জন এবং পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আলিফ হত্যাকা-ের পর মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সাড়াঁশি অভিযান চালায় যৌথবাহিনীর সদস্যরা। এসব অভিযানে ৩০ জনকে আটক করা হয়। যাচাই বাছাই করে ২৭ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়।

নওমুসলিমদের পক্ষে থাকায় টার্গেট আলিফ
নবীন আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। একইসাথে তিনি জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য। চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের এই মেধাবী ছাত্র ২০১৮ সালে জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হওয়ার পর হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবেও নিবন্ধিত হন। তিনি অন্যান্য ফৌজদারি মামলার সাথে নওমুসলিমদের বিভিন্ন মামলা পরিচালনা করতেন। নওমুসলিমদের সাহায্যকারী হিসেবে আদালতে তার সুনামও ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে যারা অন্য ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আসতে চাইতেন তাদের আইনি সহযোগিতা দিতেন আলিফ। তার সহকর্মীরা বলছেন, মূলত এ কারণেই তাকে টার্গেট করেছে উগ্রবাদী ইসকনের সদস্যরা।

ককটেলসহ গ্রেফতার ৬ জন
ইসকনের পক্ষে সহিংসতা সৃষ্টির প্রাক্কালে মঙ্গলবার রাত পৌনে ১১টায় পাহাড়তলী থেকে ককটেলসহ নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ছয় সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা হলেন- যুবলীগের সক্রিয় কর্মী আব্দুর রহিম, মীরসরাই ১৩নং মায়ানী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মোহাম্মদ আবু হেনা, মায়ানী ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ মোমিনুল ইসলাম, মীরসরাই ১২নং খৈয়াছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ, খৈয়াছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন খান এবং মীরসরাই ১৩নং মায়ানী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মোহাম্মদ ইয়াছিন উল্লাহ। আজ তাদের আদালতে হাজির করা হবে বলেও পাহাড়তলী থানা পুলিশ জানিয়েছে।

আইনজীবীদের আদালত বর্জন
সহকর্মী আলিফ হত্যার প্রতিবাদে গতকাল আদালত বর্জন কর্মসূচি পালন করেছেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্যরা। হত্যাকারী খুনিদের বিচারের দাবিতে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ মিছিল করেন আইনজীবীরা। একই দাবিতে সমিতির পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও কালোব্যাজ ধারণ করা হয়। বাদ জোহর কোর্টহিল জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় দোয়া মাহফিল। সহকর্মীর হত্যার ঘটনায় ২৮ নভেম্বর অবকাশকালীন প্রীতি সমাবেশ বাতিল এবং সমিতির বার্ষিক ইনডোর গেমস স্থগিত করা হয়েছে। পহেলা ডিসেম্বর আদালত প্রাঙ্গণ থেকে শোক মিছিলের কর্মসূচি দেয়া হয়েছে।

সহিংসতায় তিন মামলা
আদালত এলাকায় সহিংসতার ঘটনায় তিনটি মামলা করেছে পুলিশ। গতকাল কোতোয়ালী থানায় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় এসব মামলা দায়ের করা হয়। এ তিন মামলায় ২৮ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। নগর পুলিশের এডিসি কাজী তারেক আজিজ জানান, আদালত প্রাঙ্গণে হামলার ঘটনায় ৪৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ৬০০-৭০০ জনকে, রঙ্গম সিনেমা হল এলাকায় ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে ৩০০-৪০০ জনকে অজ্ঞাত এবং কোতোয়ালী মোড়ের ঘটনায় ১৩ জনকে আসামি ও অজ্ঞাত ২৫০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া আইনজীবী আলিফ খুনের ঘটনায় পৃথক মামলা হবে বলেও জানান তিনি।

This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!

Report

What do you think?

Written by Sultana

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

GIPHY App Key not set. Please check settings

Loading…

0

নব্য বিএনপিরাই সন্ত্রাস নৈরাজ্যের সাথে জড়িত : আমিনুল হক