ভারতীয়দের অবৈধ মাছ শিকারে বিপাকে পড়েছেন শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলীয় জাফনা উপকূলের জেলেরা। তারা রোজ সমুদ্রে যান, কঠোর পরিশ্রম করেন, কিন্তু ফিরে আসেন সামান্য কিছু কম দামি মাছ নিয়ে। স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ, আগে যেখানে তারা ছয় ঝুড়ি মাছ সংগ্রহ করতে পারতেন, এখন এক ঝুড়িও পূরণ করতে পারছেন না। ভারতীয় ট্রলারগুলো অবৈধভাবে শ্রীলঙ্কার জলসীমায় প্রবেশ করে সব মাছ ধরে নিচ্ছে। এটি লঙ্কান জেলেদের জীবিকায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
রাজেন্দ্রন মাধিয়ালাগান নামে স্থানীয় এক জেলে বলেন, প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে শত শত ভারতীয় ট্রলার আমাদের সমুদ্রে প্রবেশ করে, বড় জাল দিয়ে সব মাছ ধরে নেয় এবং আমাদের জাল ছিঁড়ে ফেলে।
শ্রীলঙ্কার জলসীমায় ভারতীয়দের অবৈধ মৎস্য শিকারে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতেই হচ্ছে না, তারা পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি করছে।
ভারতীয় ট্রলারগুলো ‘বটম ট্রলিং’ নামে এক নিষিদ্ধ পদ্ধতি ব্যবহার করে, যা সমুদ্রের তলদেশের জৈবিক বৈচিত্র্য ধ্বংস করে দেয়। শ্রীলঙ্কা ২০১৭ সালে এই প্রযুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ভারতীয় ট্রলারগুলোর বটম ট্রলিং অব্যাহত রয়েছে।
শ্রীলঙ্কার কড়া পদক্ষেপ
শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনী নিয়মিতভাবে ভারতীয় জেলেদের আটক করছে। ২০২৩ সালে ২৪০ জন ভারতীয় জেলে ও ৩৫টি ট্রলার আটক করে তারা। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৪ জন জেলে ও ৭২টি ট্রলারে। চলতি বছর জানুয়ারিতেই ৬০ জনের বেশি ভারতীয় জেলেকে আটক করা হয়েছে।
গত ২৮ জানুয়ারি শ্রীলঙ্কার ডেলফ্ট দ্বীপের কাছে ভারতীয় ট্রলারের ওপর গুলি চালায় লঙ্কান নৌবাহিনী। এতে পাঁচজন আহত হন, যাদের মধ্যে দুইজনের আঘাত ছিল গুরুতর। এই ঘটনায় ভারত কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, কোনো পরিস্থিতিতেই শক্তি প্রয়োগ গ্রহণযোগ্য নয়।
কূটনৈতিক টানাপোড়েন ও ভারতের অবস্থান
ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে এই দ্বন্দ্ব কূটনৈতিক অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ডিসেম্বরে ভারত সফরে গিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমারা দিসানায়েকে এই বিষয়টি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সামনে উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, নিষিদ্ধ বটম ট্রলিংয়ের ফলে অপরিবর্তনীয় পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে। আমি এই অনৈতিক মাছ ধরার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।
জবাবে মোদী বলেন, উভয় দেশের জেলেদের জীবিকা রক্ষায় মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা দরকার। তবে শ্রীলঙ্কার অভিযোগ, ভারত এখনো এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
শ্রীলঙ্কায় বাড়ছে ভারতবিরোধী মনোভাব
ভারতীয় ট্রলারের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলের মৎস্যজীবীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। ২০২১ সালে তারা ‘কালো পতাকা’ নিয়ে সমুদ্রে বিক্ষোভ করেছিলেন। শ্রীলঙ্কার তামিল রাজনীতিবিদ মাধিপারানান সুমন্থিরন বলেন, ভারত সরকার প্রথমে পদক্ষেপ নিয়েছিল, কিন্তু এখন আবার এটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
লঙ্কান জেলেরা মনে করেন, ভারতীয় ট্রলারের অনুপ্রবেশ শুধু তাদের জীবিকা নয়, বরং তাদের সমাজকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জাফনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ আহিলান কাধিরগামার বলেন, এটি একটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, যা তাদের চোখের সামনে ঘটছে, কিন্তু তারা অসহায়।
স্থানীয় জেলে মাধিয়ালাগান বলেন, আমাদের ৪০টি জালের মধ্যে ৩০টি ভারতীয় ট্রলারের কারণে ছিঁড়ে যায়। তারা আলো নিভিয়ে সমুদ্রে নামে এবং বিশাল সংখ্যায় উপস্থিত হয়, যা আমাদের জন্য ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।
এই পরিস্থিতিতে, শ্রীলঙ্কার জেলেরা দ্রুত সমাধান চাইলেও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা কতটা কার্যকর হবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!
GIPHY App Key not set. Please check settings