দেশের পেঁয়াজের বাজারে হঠাৎ শুরু হয়েছে অস্থিরতা। মাত্র পাঁচ-ছয় দিনের ব্যবধানে কেজিতে দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। রাজধানীর বাজারগুলোতে এখন ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। আমদানিকারকদের দাবি, সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে। গত মাসে মুড়িকাটা পেঁয়াজ লাগানো হয়েছে। কিন্তু কয়েকদিন আগে ভারী বৃষ্টিপাতে সেসব পেঁয়াজ গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। সরকার আমদানির অনুমতি দিলে দুই দিনের মাথায় দাম অর্ধেকে নেমে যাবে।
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত পেঁয়াজ আছে। এ মুহূর্তে আমদানির অনুমতি দিলে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, এটি দামের কোনো স্বাভাবিক ওঠানামা নয় বরং একটি সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়েছে; যাতে সরকার আমদানির অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।
সরবরাহ ঘাটতির কারণে দাম বাড়ছে এমন অজুহাত মানতে নারাজ ভোক্তাসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কৃষকের ঘরে পেঁয়াজ কমে গেছে। পেঁয়াজ চলে গেছে মজুতদারদের হাতে। প্রতিবছর এই সময় পেঁয়াজের সংকট দেখিয়ে দাম বাড়ানো হয়। এবারও মজুতদাররা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজ আটকে রেখে দাম বাড়াচ্ছে। সরকারি সংস্থাগুলোকে এখনই তদারকি ও নজরদারি বাড়াতে হবে। সারাদেশে কী পরিমাণ পেঁয়াজ মজুত আছে তা খতিয়ে দেখার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান তারা।
বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক, তবু দাম বাড়ছে
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ। তবে এক বছর আগের তুলনায় দাম এখনও ২২ শতাংশ কম। গতকাল বুধবার রাজধানীর মালিবাগ, কারওয়ান বাজার ও আগারগাঁওয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি কেজি দেশি ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। পাঁচ-ছয় দিন আগে এই দাম ছিল ৮০ টাকার আশপাশে। সেই হিসাবে কেজিতে বেড়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
আমদানিকারক ও বড় পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে দৈনিক পেঁয়াজের চাহিদা ছয় থেকে সাত হাজার টন। কিন্তু বাজারে এখন যে পেঁয়াজ রয়েছে তা দিয়ে এ চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। মুড়িকাটা পেঁয়াজ লাগানো শুরু হয়েছে প্রায় মাসখানেক আগে থেকে। এখন চাষির ঘরে পেঁয়াজ নেই বললেই চলে। দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসবে। তাই আমদানির বিকল্প নেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা রয়েছে ২৫ থেকে ২৭ লাখ টন। দেশীয় উৎপাদন ৩৫ থেকে ৩৭ লাখ থেকে লাখ টন। পেঁয়াজ সংরক্ষণের সময় প্রক্রিয়াজাতকরণে নষ্ট হয়ে যায় ২৫ শতাংশের মতো। ফলে প্রতি বছর ছয় থেকে সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। বিশেষ করে ভারত প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় সহজে ও কম সময়ে দেশটি থেকে বাংলাদেশ পেঁয়াজ আমদানি করতে পারে। কিন্তু এখন আমদানি বন্ধ রয়েছে।
কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আকাশ চন্দ্র বলেন, প্রতি বছর এ সময় পেঁয়াজের কিছুটা সংকট থাকে। তিন-চার দিন ধরে মোকামে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। ভারত থেকেও আসছে না। এ কারণে খুচরা বাজারে দাম বাড়ছে। আমদানি না হলে দাম আরও বাড়তে পারে।
আমদানিকারক ও শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মাজেদ সমকালকে বলেন, বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে গেছে। যারা আগে কিনে রেখেছেন তাদের কাছে কিছু পেঁয়াজ আছে। আমদানির পথ খুলে দিলে দুই দিনের মাথায় কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকায় নেমে আসবে। আর যদি অনুমোদন না দেয়, তাহলে দাম আরও বাড়বে।
বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে না তারপরও দাম বাড়ছে কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দাম বাড়ার কারণে কম আয়ের মানুষ কেনা কমাচ্ছে। এ জন্য সরবরাহ ঘাটতির বিষয়টি টের পাওয়া যাচ্ছে না।
আইপি বন্ধ, সিন্ডিকেটের চাপ বাড়ছে
বাজারে অস্থিরতা তৈরি হলেও কৃষি মন্ত্রণালয় এখনই পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি বা ইমপোর্ট পারমিট (আইপি) দিতে নারাজ। তাদের যুক্তি, এখন আমদানি করলে স্থানীয় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুর রহমান বলেন, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ এ মাসেই বাজারে আসবে। এখন আমদানির অনুমতি দিলে কৃষক বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন। কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করাই আমাদের অগ্রাধিকার।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ে ইতোমধ্যে দুই হাজার ৮০০টি আইপি আবেদন জমা পড়েছে। অনেক ব্যবসায়ী আইপি ছাড়া এলসি খুলে পেঁয়াজ বন্দরে এনে সরকারকে চাপ দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ভারত থেকে প্রতি কেজি ২০ রুপি দরে কেনা পেঁয়াজ কাগজে ৩০ রুপি দেখানো হয়, এতে টাকার পাচারও হচ্ছে।
সূত্রটি আরও জানায়, কিছু ব্যবসায়ী ভারতের সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কম দামে পেঁয়াজ কিনে দেশে এনে বেশি দামে বিক্রি করেন। হাইকোর্টে আইপি না দেওয়ার বিরুদ্ধে করা ১৪টি রিটও ইতোমধ্যে খারিজ হয়েছে।
হিলি বন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক জানান, অনেক ব্যবসায়ী আইপি না পেয়ে এখন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা এলসি খুলে পেঁয়াজ বন্দরে এনেছেন, এখন সরকারের অনুমতি না থাকায় ছাড়াতে পারছেন না।
এ ব্যাপারে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে দাম বাড়ানোর ফন্দি-ফিকির সব সময় করেন। এখন নির্বাচন ও রাজনৈতিক চাপে থাকায় নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নজর কম। ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ হাতছাড়া করছেন না। পেঁয়াজের আইপি বন্ধ করা হয়েছে অনেক আগে, হঠাৎ করে দাম দ্বিগুণ হওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। আইপি বন্ধের অজুহাতে ব্যবসায়ীরা মানুষের পকেট কাটছে। ডিসেম্বর মাসে মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসবে। তাই এ মুহূর্তে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে অস্থিরতা বন্ধ করতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) ড. জামাল উদ্দীন বলেন, এই মুহূর্তে দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই। এটি কারসাজি ছাড়া আর কিছু নয়। বিগত ১৫ বছরে যারা বিভিন্নভাবে সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করত, তারা তো এখন সুবিধা করতে পারছে না। ফলে সময়ে সময়ে তারা ফের সক্রিয় হয়ে বাজার অস্থির করার চেষ্টা করছে।
কৃষকরা চান আমদানি বন্ধ থাকুক
গত বছর পেঁয়াজসহ কয়েকটি ফসলের দাম না পেয়ে কিছু কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এবার পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ফসলের ফলন ভালো; তাই তারা দাম পাওয়ার আশায় আছেন। ভরা মৌসুমের আগে যদি ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে ঢুকে যায়, তাহলে কৃষক আবারও ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। মাঠের কৃষকরা চান, সরকার যেন আমদানি বন্ধ রাখে। পাবনার চাটমোহরের কৃষক রণজিৎ চন্দ্র দাশ বলেন, প্রতি কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে ৪০ টাকা খরচ হয়। এখন ভারতীয় পেঁয়াজ এলে আমাদের ফসল বিক্রি হবে না। সরকার আমদানি বন্ধ না করলে আমরা টিকতে পারব না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. এমদাদ উল্লাহ বলেন, আমাদের লক্ষ্য দুই দিকেই ভারসাম্য রাখা– কৃষক যেন লাভবান হন, ভোক্তাও যেন ন্যায্যমূল্যে পণ্য পান। স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সরকার ইতোমধ্যে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে জোর দিয়েছে। এবার কৃষকদের মধ্যে ৫০ টন উন্নত জাতের বীজ ও বিনামূল্যে সার বিতরণ করা হয়েছিল। পেঁয়াজ সংরক্ষণে আট হাজার ‘এয়ার ফ্লো মেশিন’ স্থাপন করা হয়েছে, যা পেঁয়াজের আয়ু বাড়াতে সাহায্য করছে।
This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!



GIPHY App Key not set. Please check settings