বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের সময় নিয়ে এক অপরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস থেকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন বিবাদে রূপ নিয়েছে। এর জেরে বেড়েছে পাল্টাপাল্টি বক্তৃতা-বিবৃতি।
বিএনপির সঙ্গে তার এক সময়ের মিত্র জামায়াতের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল কয়েক বছর ধরে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার শাসনের পতনের পর দল দুটির সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়তে থাকে।
সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে– এই প্রশ্নে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে বিবাদে জড়ায় বিএনপি-জামায়াত।
এরই মধ্যে জাতীয় সংসদের বিভিন্ন আসনে জামায়াতের দলীয় প্রার্থীও ঘোষণা করে। দলটির এমন তৎপরতায় আস্থার অভাব ও সন্দেহ বেড়ে যায় বিএনপিতে।
সর্বশেষ স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে দল দুটি। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচন চায় না। আর জামায়াত আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাইছে।
নানা ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের বিবাদ এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, দল দুটির নেতারা এখন কোনো না কোনো বিষয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন।
সংস্কার প্রশ্নে বিবাদের শুরু
অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই বিএনপি ন্যূনতম সংস্কার করে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দাবি করে আসছে। আর জামায়াত দাবি করে আসছিল–– ‘সার্বিকভাবে সংস্কারের পরই নির্বাচন’।
দলটি অবশ্য সেই অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে এখন নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলছে। তবে জামায়াত নির্বাচনের সময় নিয়ে বিএনপির থেকে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে।
জামায়াত বলেছে, প্রয়োজনীয় সংস্কারের যতটা সময় প্রয়োজন হবে, সেই সময় সরকারকে তারা দেবে। আর বিএনপি অবস্থান হচ্ছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে।
অন্যদিকে ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে পারে’– এমন খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হলে এ নিয়েও বিরোধে জড়িয়েছেন দুই দলের নেতারা। যদিও সরকার বা নির্বাচন কমিশনের দিক থেকে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য এখনও আসেনি।
বরং প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর নাগাদ জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন বলে বিএনপি সম্প্রতি এক বৈঠকের পর দাবি করেছে।
এরপর ১৩ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্টস সামিট (ডব্লিউজিএস)-এর ইন্টারঅ্যাকটিভ প্ল্যানারি অধিবেশনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও একই সময়রেখার কথা উল্লেখ করেছেন।
তিনি জানান, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পর চলতি বছরের ডিসেম্বরেই জাতীয় নির্বাচন হতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এক বৈঠকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনে তাদের সমর্থনের কথা জানালে তা বিএনপিকে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ করেছে।
বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা জানিয়েছেন, তাদের ধারণা বিএনপি যাতে নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী না হতে পারে সেজন্যই জামায়াত ‘নির্বাচন প্রলম্বিত করতে’ নানা ধরনের তৎপরতা শুরু করেছে।
যদিও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে তাদের দূরত্ব বা বিরোধিতার কোনো ব্যাপার নেই। বরং বিএনপির মতো তারাও তাদের দলীয় কাজ করে চলেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দৈনিক নয়া দিগন্তের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সালাউদ্দিন বাবর বলছেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার এ বিরোধের মূল কারণ হলো নির্বাচন।
তিনি বলেন, “বিএনপি ভাবছে জামায়াত ৩০০ আসনে প্রার্থী দিচ্ছে বা তারা অন্য ধরনের কিছু করতে পারে। আবার জামায়াত মনে করছে সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সেটি আর জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী বাস্তবায়ন হয় কি না। এমন কিছু বিষয়েই দল দুটির চিন্তার ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে”।
এর আগে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের একটি বক্তব্যের জের ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন বিএনপি নেতারা।
গত ২৭ ডিসেম্বর দলটির কর্মী সম্মেলনে “একজন চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেকজন চাঁদাবাজিতে লেগে গেছে” বলে মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
সালাউদ্দিন বাবর বলেছেন, বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের মধ্যে বিরোধের মূল কেন্দ্রে আছে জাতীয় নির্বাচন, অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচন কখন হবে কিংবা কোনটি আগে হবে- জাতীয় নির্বাচন নাকি স্থানীয় নির্বাচন।
জামায়াতের বিকল্প জোট গঠনের তৎপরতাও বিবাদ বাড়িয়েছে
যদিও গত কয়েক মাসে দল দুটির মধ্যে যেসব বিষয়ে বিরোধ দেখা গেছে তার মধ্যে দ্রুত নির্বাচন ইস্যুটি ছাড়াও আছে জুলাই আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে বক্তব্য, ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিয়ে জোট, নতুন দল গঠনের তৎপরতা এবং নির্বাচনের আগে সংস্কার বাস্তবায়নের মতো ইস্যুগুলো।
বিএনপির একটি বড় অংশ মনে করে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতা ও সংগঠক প্রায়শ বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বকে ঘিরে যেসব ‘তির্যক’ মন্তব্য করে থাকেন তাতে জামায়াতের ‘আশকারা’ রয়েছে।
এর মধ্যে জামায়াত ধর্মভিত্তিক অন্য দলগুলোকে নিয়ে একটি জোট গড়ার উদ্যোগ নিলেও সেই সম্ভাবনা অনেকটাই ফিকে হয়ে আসছে বিএনপির পাল্টা উদ্যোগের কারণে।
জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান সম্প্রতি ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের সঙ্গে সাক্ষাতের পরপরই বিএনপির মহাসচিব ঢাকায় তার সঙ্গে যে বৈঠক করেছেন- তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
আবার জামায়াত যোগাযোগ করেছে এমন আরো কিছু ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে বিএনপি এর মধ্যেই কয়েক দফা বৈঠক করেছে।
যদিও জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেছিলেন, “তাদের জোট গঠনের যে প্রচেষ্টা সেটি নির্বাচন এগিয়ে আসলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে”।
গণঅভ্যুত্থানে কৃতিত্ব নিয়েও পাল্টাপাল্টি অবস্থান
এছাড়া জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে বিএনপির ভূমিকাকে প্রশ্ন করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও তাদের ঘনিষ্ঠ জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা যে প্রশ্ন তোলেন– সেটি জামায়াতের ইন্ধনেই হচ্ছে বলে মনে করেন বিএনপির অনেকেই।
বিএনপি দাবি করে, ছাত্রদের আন্দোলনে চূড়ান্তভাবে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও এর ভিত্তি তৈরি হয়েছে তারেক রহমানের নেতৃত্বে তাদের গত ১৫ বছরের আন্দোলনের মাধ্যমে।
আবার আন্দোলনকারী ছাত্রদের দল গঠনের বিষয়েও বিএনপি তার অবস্থান পরিষ্কার করে ‘ক্ষমতায় থেকে দল গঠনের’ উদ্যোগের সমালোচনা করেছে।
কিন্তু জামায়াত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। বিএনপির অনেকের ধারণা ছাত্রদের এ দল গঠন প্রক্রিয়াকেও উৎসাহিত করছে জামায়াত।
এর মধ্যে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর একটি মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছে জামায়াত এবং এটি দল দুটির মধ্যকার বিরোধের সূত্রপাতের পর প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানোর ঘটনা।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর বাগমারায় এক অনুষ্ঠানে রিজভী বলেছিলেন “জামায়াতে ইসলামীর প্রতি উদারতা দেখিয়ে বিএনপি উপহার হিসেবে মুনাফেকি পেয়েছে”।
জবাবে জামায়াত মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “তার (রিজভী) এই সব কথার কোনো ভিত্তি নেই। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি ভারতের আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। জামায়াতের এই ভূমিকা গোটা জাতি গ্রহণ করেছে। আর এ কারণেই সম্ভবত জনাব রিজভীর গাত্রদাহ সৃষ্টি হয়েছে।”
এরপর ২৯ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “৫ আগস্টের পর কি আমরা ব্যাংক আত্মসাৎ করতে দেখিনি? আমরা তো দেখেছি ইসলামী ব্যাংক কীভাবে গ্রাস করে নিলো একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা।”
তখন রিজভীর বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অফিসিয়াল ফেসবুকে পোস্ট দেয় জামায়াতে ইসলামী। ফটোকার্ড বানিয়ে পোস্টটির জবাবও দেয় বিএনপি।
আবার ডিসেম্বরের শেষদিকেই জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের নিজেদের “পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক শক্তি” হিসেবে দাবি করার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এখন সবশেষ জামায়াত সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে সমর্থন করায় বিএনপির মধ্যে জামায়াত-বিরোধিতা আরো শক্ত আকার ধারণ করেছে।
এর মধ্যেই আগামী নির্বাচনের জন্য ৩০০ আসনের প্রায় সবগুলোতেই প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে জামায়াত।
মিয়া গোলাম পরওয়ার সম্প্রতি বলেছেন, এখন জেলা পর্যায় থেকে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন এলে তারা কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থী ঘোষণা করবেন।
সালাউদ্দিন বাবর অবশ্য বলছেন, জামায়াত নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তারা আগে সংস্কার চাইছে কারণ তারা মনে করে নির্বাচনের পর সংস্কার বাস্তবায়ন হলে সেখানে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাব ফেলতে পারে।
“এটিই উভয় দলের মধ্যকার বর্তমান দূরত্বের কারণ বলে মনে করি। ইলেকশন নিয়েই বিভক্তি ও মতপার্থক্য। দ্রুত নির্বাচন জামায়াত চায় না। তারা সরকারকে সংস্কারের জন্য সময় দিতে চাইছে। অন্যদিকে বিএনপি মনে করছে জামায়াত হয়তো অন্য কিছু করছে যাতে নির্বাচন বিলম্বিত হয়”
This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!
GIPHY App Key not set. Please check settings