বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের দেশের ছয়টি ব্যাংক থেকে বের করে নেয়া ৯৭ হাজার কোটি টাকার বেনামি ঋণের বেশির ভাগেরই সুবিধাভোগী পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহেনাসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা বলে মনে করছেন তদন্ত সংস্থাগুলো। কারণ, এসব অর্থের বেশির ভাগ অর্থই ব্যাংক থেকে নগদ উত্তোলন করা হয়েছে। আর উত্তোলিত অর্থের বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে। দেশী-বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এরই মধ্যে এসব অর্থের গন্তব্য নিয়ে কাজ শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে কিছু সুনির্দিষ্ট গন্তব্যই চিহ্নিত করা হয়েছে। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ বাজেয়াপ্ত করারও কাজ শুরু হয়েছে। আর এসব কাজে আইনগত ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে একাধিক দেশের গোয়েন্দা সংস্থা। সংশ্লিষ্ট এক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছেন এমন একটি সংস্থার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এস আলম অভিনব পন্থায় ব্যাংকগুলো থেকে নামে-বেনামে অর্থ বের করে নিয়েছে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে দুই লাখ ২৫ হাজার ২৯ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে এস আলম। আর তার এ কাজে সরাসরি সহযোগিতা করেছিল পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবারসহ রাষ্ট্রযন্ত্র। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তাও এর সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। আর এ কারণে ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও গা ঢাকা দেন। তিনি ৫ আগস্টের পর আর বাংলাদেশ ব্যাংকে আসেননি। কেউ কেউ বলছেন, তিনি দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে পারেননি, দেশেই কোথাও পালিয়ে আছেন। তার প্রত্যক্ষ মদদে এস আলমের পিএস ও পরবর্তীতে ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি আকিজ উদ্দিন এস আলমের টাকা বের করে দিতে সহায়তা করেন বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার মারফত জানা গেছে, এস আলম ছয়টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৯৭ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা বেনামি ঋণ নিয়েছে। এর বেশির ভাগ অর্থই নগদে উত্তোলন করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বেনামি ঋণ নিয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩৯ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নেয়া হয়েছে ২২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নিয়েছে ১৯ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নিয়েছে ১১ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ বেনামি ঋণ নেয়া হয়েছে দুই হাজার ৮১১ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নেয়া হয়েছে এক হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এস আলমের বেনামি ঋণের বেশির ভাগই নগদে উত্তোলন করা হয়েছে। আর এস আলমের এসব বেনামি ঋণ নিতে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহী থেকে শুরু করে কিছু কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে সরাসরি ভূমিকা রেখেছে এস আলমের পিএস ও পরবর্তীতে ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি আকিজ উদ্দিন, আরেক ডিএমডি মিফতা উদ্দিন, কোম্পানি সেক্রেটারি জেকিইএম হাবিবুল্লাহ, ইউনিয়ন ব্যাংকের পলাতক এমডি মোকাম্মেল, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ডিএমডি আব্দুল কাদেরসহ দেড় ডজন কর্মকর্তা। আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিন ও মোকাম্মেল দেশ থেকে পালিয়ে গেলেও অন্য কর্মকর্তারাও এখনো বহাল তবিয়তে আছেন।
১১ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে নিয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা : এস আলমের পাচারকৃত টাকা উদ্ধারের কার্যক্রমের সাথে জড়িত রয়েছে এমন একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এস আলম একাই ১১ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে নিয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ বের করে নিয়েছে ইসলামী ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। এরপর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছে ৪৫ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছে ১২ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। আল-আরাফাহ থেকে বের করে নিয়েছে ৩৭৬ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো ২০১৭ সালের পর রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে সাবেক মালিকদের বের করে নিজের দখলে নেন এস আলম। নতুন প্রজন্মের দু’টি ব্যাংক দখলে নেয় মাফিয়া এস আলম। এ দু’টি ব্যাংকে সাধারণ আমানতকারীরা যে পরিমাণ আমানত রেখেছিলেন তার পুরো অর্থই বের করে নেয় এস আলম। পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংক থেকেও ধার করে দু’টি ব্যাংকে ঢুকিয়ে ওই অর্থও বের করে নেয়। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে বের করে নেয় ২৩ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে বের করে নেয় ১৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এসব অর্থের একটি অংশ পতিত প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকেও দেয়া হয় বলে তদন্ত সংস্থা সূত্র জানিয়েছে।
এর বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকেও অর্থ বের করে নেয় এস আলম। প্রতিবেদন অনুসারে জনতা ব্যাংক থেকে ৫ বছরে বের করে নেয় ১২ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। এর বাইরে পারস্পারিক যোগসাজশে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে বের করে নেয় প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এস আলমের দখলে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয় ৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে। বিপরীতে এস আলম এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় ৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এসব অর্থ পরিশোধ করা হতো না। অপরদিকে ন্যাশনাল ব্যাংকের শিকদার গ্রুপের সাথেও ঋণ ভাগাভাগি করেন এস আলম। একপর্যায়ে ন্যাশনাল ব্যাংকই দখল করে নেন তিনি।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে এস আলম ঋণ নিয়েছে ২ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল ব্যাংকের তালিকায় দীর্ঘ দিন ধরে রয়েছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। ওই কমার্স ব্যাংক এস আলম দখল করে ৯৯৫ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। এর বাইরে এক সময়ে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের রিলায়ন্সের এমডি করা হয়েছিল পিকে হালদার। পিকে হালদার নিজেও প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা এ ব্যাংক থেকে বের করে নেয়। সাথে এস আলমকেও বের করে দেয়া হয় ১ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের কোনো অর্থই ফেরত দিতে পারছে না। খোলস পাল্টে নতুন করে নাম রাখা হয়েছিল আভিভা ফাইন্যান্স। এখন আভিভা ফাইন্যান্স নামেই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়ে আসছে।
This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!
GIPHY App Key not set. Please check settings