in

ভারতে শেখ হাসিনার ১০০ দিন, কীভাবে রয়েছেন-সামনেই বা কী?

আজ থেকে ঠিক ১০০ দিন আগে আগস্টের ৫ তারিখ চরম নাটকীয় পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা যখন ভারতে পা রাখেন, দিল্লির বিশ্বাস ছিল যে তার এই আসাটা একেবারেই সাময়িক- ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে যাওয়ার আগে এটা একটা সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতির বেশি কিছু নয়!

যে কোনো মুহূর্তে তৃতীয় কোনো দেশে চলে যাবেন- এই ধারণা থেকেই প্রথম দু-চারদিন শেখ হাসিনা ও সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানাকে রাখা হয়েছিল দিল্লির উপকণ্ঠে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমান ঘাঁটির টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে, যেটির নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার ভারতীয় বিমান বাহিনীর।

কিন্তু চট করে শেখ হাসিনার তৃতীয় কোনো দেশে পাড়ি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর ভারত সরকার তাকে হিন্ডন থেকে সরিয়ে আনে দিল্লির কোনো গোপন ঠিকানায়। পরে তাকে হয়তো দিল্লির কাছাকাছি অন্য কোনো সুরক্ষিত ডেরায় সরিয়েও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে ভারত সরকার এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।

কিন্তু ‘লোকেশন’ যাই হোক, ভারতে তার পদার্পণের ১০০ দিনের মাথায় এসে এই প্রশ্নটা ওঠা খুব স্বাভাবিক যে এখন শেখ হাসিনাকে কীভাবে ও কী ধরনের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে? আর সেটার পেছনে কারণটাই বা কী?

পাশাপাশি এই ‘এক্সট্রাঅর্ডিনারি সিচুয়েশন’ বা চরম অস্বাভাবিক একটা পরিস্থিতিতে তিনি স্বাধীনভাবে কতটা কী করতে পারছেন? কিংবা ‘হোস্ট কান্ট্রি’ হিসেবে ভারত কি তাকে কোনো কাজ না করারও অনুরোধ জানিয়েছে?

দিল্লিতে একাধিক মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা ও ওয়াকিবহাল মহলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বিবিসি বাংলা এসব প্রশ্নের যে উত্তর পেয়েছে, এই প্রতিবেদনে থাকছে তারই সারাংশ।

নিরাপত্তা প্রোটোকলটা ঠিক কী রকম?

‘অপ্রত্যাশিত অথচ অতি গুরুত্বপূর্ণ’ অতিথি শেখ হাসিনার জন্য ভারত এখন ঠিক কোন ধরনের নিরাপত্তা প্রোটোকল অনুসরণ করছে?

হুবহু এই প্রশ্নটিই করা হয়েছিল ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে, যিনি গত একশ দিন ধরে ভারতে শেখ হাসিনার প্রতিটি পদক্ষেপের বিষয়ে সবকিছুই জানেন।

খুদে বার্তায় তিনি ছোট ছোট তিনটা বাক্যে এই প্রশ্নের যে উত্তর দিলেন, তা এরকম :

এক. ‘বেয়ার মিনিমাম, প্লেইন ক্লোদস, নো প্যারাফারনেলিয়া’

যার অর্থ হলো- যেটুকু না হলে নয়, শেখ হাসিনাকে সেটুকু নিরাপত্তাই দেওয়া হয়েছে। সাদা পোশাকের রক্ষীরাই তার চারপাশে ঘিরে রয়েছেন (জলপাই রঙের পোশাকধারী কমান্ডো বা সেনা সদস্যরা নন। আর গোটা বিষয়টার মধ্যে কোনো আতিশয্যার বালাই রাখা হয়নি। মানে ঢাকঢোল পিটিয়ে বা ঘটা করে তাকে কোনো নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে না, বরং পুরো জিনিসটা খুব নিচু তারে বেঁধে রাখা হয়েছে।

দুই. ‘ইন হার কেস, সিক্রেসি ইজ দ্য সিকিউরিটি’

সোজা কথায়, তার বেলায় গোপনীয়তাই হলো নিরাপত্তা। এটারও অর্থ খুব সহজ। শেখ হাসিনার অবস্থানের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে গোপনীয়তা রক্ষার ওপর। কারণ তিনি কোথায়, কীভাবে আছেন এটা যত গোপন রাখা সম্ভব হবে, ততই তার নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করা সহজ হবে।

তিন. ‘মুভমেন্টস অ্যান্ড ভিজিটস- অ্যাজ লিটল অ্যাজ পসিবল’

ওই কর্মকর্তা তার তৃতীয় বাক্যে জানান, শেখ হাসিনাকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া কিংবা তার সঙ্গে অন্যদের দেখা করানোর ব্যবস্থা- এটাও যতটা সম্ভব এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে শেখ হাসিনার মুভমেন্টস বা ভিজিটস যে পুরোপুরি বন্ধ নয়, তার কথায় সে ইঙ্গিতও ছিল।

ওই কর্মকর্তার কথা থেকে স্পষ্ট, শেখ হাসিনার জন্য কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকলেও, সেটা খুব বিশেষ এক ধরনের আয়োজন। মানে ধরা যেতে পারে, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য যে ধরনের নিরাপত্তা থাকে তার সঙ্গে সেটা মাত্রায় তুলনীয় হলেও, আয়োজনে একেবারেই অন্য রকম।

শেখ হাসিনাকে যাতে কোনোভাবেই প্রকাশ্যে না আসতে হয়, এই প্রোটোকলে সেই চেষ্টাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

ফলে দিল্লির মর্নিং ওয়াকারদের স্বর্গ লোদি গার্ডেনে তিনি এসে মাঝেমাঝে হাঁটাহাঁটি করে যাচ্ছেন কিংবা ইচ্ছে করলে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কাওয়ালি শুনে আসছেন- এই ধরনের যাবতীয় জল্পনা হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছেন ভারতের সংশ্লিষ্ট মহলের কর্মকর্তারা।

সেই সঙ্গেই তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে, এর অর্থ হলো তার সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দায়িত্বও কিন্তু এখন ভারতেরই কাঁধে। সেখানে সামান্য কোনো ভুল হলেও, তার দায় ভারতের কাঁধেই আসবে ও সেটা দিল্লির জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর হবে।

ফলে সেই নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো আপস করা যাবে না এবং তার জীবনকে সামান্যতম ঝুঁকিতেও ফেলা যাবে না। পাশাপাশি পুরো বিষয়টা অত্যন্ত গোপন রাখতে হবে- এগুলো বিবেচনায় নিয়েই সাজানো হয়েছে তার নিরাপত্তা প্রোটোকল।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কতটা অবাধ?

গত তিন মাসে শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ‘কথিত’ ফোনালাপের বেশকিছু অডিও ‘ভাইরাল’ হয়েছে, যাতে একপক্ষের কণ্ঠস্বর হুবহু শেখ হাসিনার মতোই শোনাচ্ছে। ভারত যদিও এসব ‘ফাঁস’ হওয়া অডিও নিয়ে সরকারিভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে একাধিক পদস্থ সূত্র একান্ত আলোচনায় স্বীকার করেছেন এগুলো বাস্তবিকই শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর!

দিল্লির নর্থ ব্লকের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমি জানি না এটা এআই দিয়ে বানানো হয়েছে, নাকি শেখ হাসিনার নিজেরই গলা। তবে তার তো পরিচিতদের সঙ্গে কথাবার্তা বলায় কোনো বিধিনিষেধ নেই। এখন কেউ যদি সেই আলাপ রেকর্ড করে লিক করে দেন, তাতে আমাদের কী করার আছে?

ভারতের কোনো কোনো পর্যবেক্ষক আবার ধারণা করছেন, শেখ হাসিনা যাতে নিজের দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়ে তাদের মনোবল ধরে রাখতে পারেন, সেজন্য দিল্লিই এসব কথাবার্তা হতে দিচ্ছে ও পরে সুযোগ বুঝে তা ‘লিক’ও করে দিচ্ছে, যাতে তা যত বেশি সম্ভব লোকের কাছে পৌঁছাতে পারে!

এর আসল কারণটা যাই হোক, বাস্তবতা হলো- শেখ হাসিনা ভারতে গৃহবন্দিও নন বা রাজনৈতিক বন্দিও নন। ফলে দেশ-বিদেশে তার পরিচিতদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ তিনি পাচ্ছেন।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ভারতে যখন কোনো রাজনৈতিক নেতা গৃহবন্দি হন, তার বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের অধিকারও কার্যত কেড়ে নেওয়া হয়। যেমন ধরুন পাঁচ বছর আগে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পর ওমর আবদুল্লা বা মেহবুবা মুফতিদের যখন গৃহবন্দি করা হয়, তারা কিন্তু দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করা তো দুরস্থান – মোবাইল বা ইন্টারনেট সংযোগও পাননি!”

সুতরাং শেখ হাসিনা যে ভারতে মোটেই গৃহবন্দি নন, তার প্রমাণ হলো- তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা বলতে পারছেন।

দিল্লিতে থাকা মেয়ে সাইমা ওয়াজেদ বা ভার্জিনিয়ায় থাকা ছেলে সজীব ওয়াজেদের সঙ্গেও তার প্রায় প্রতিদিনই যোগাযোগ হচ্ছে। নিউজ চ্যানেল, খবরের কাগজ বা ইন্টারনেটেও তার সম্পূর্ণ অ্যাকসেস আছে।

তবে ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের যে কয়জন নেতাকর্মী পালিয়ে ভারতে চলে এসেছেন, তাদের কারও কারও সঙ্গে শেখ হাসিনার যোগাযোগ হলেও, তারা কেউই সশরীরে দলনেত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাননি।

আর ভারতের মাটিতে বসে শেখ হাসিনা যাতে এখনই নিজের বয়ানে কোনো প্রকাশ্য রাজনৈতিক বিবৃতি না দেন, সেজন্যও তাকে ভারতের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে জানতে পারা গেছে।

আসলে শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দিয়ে তারপর তার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উসকানি দিতে চাইছে– এটা যাতে কেউ বলতে না পারে, সেজন্যই দিল্লির এই সতর্ক অবস্থান!

যেহেতু শেখ হাসিনার নিজস্ব কোনো ভেরিফায়েড ফেসবুক বা এক্স অ্যাকাউন্টও নেই– ফলে এটাও দিল্লির স্বস্তির একটি কারণ, যে সেখানেও তার কোনো পোস্ট আসছে না।

কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পুনর্বাসন কি আদৌ সম্ভব? অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়টা নিয়ে দিল্লি কী ভাবছে?

ভারত এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি কথাও বলছে না সঙ্গত কারণেই। তবে ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই-কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, এই কাজটা শুধু কঠিন নয়, খুবই কঠিন। এখনো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে বিক্ষোভ চলছে। তাদের দলীয় সংগঠনও ছত্রভঙ্গ।

‘শেখ হাসিনার বয়স আজকের চেয়ে দশটা বছর কম হলেও ধরে নেওয়া যেত, তিনি দেশে ফিরে দলের হাল ধরবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।’

কিছুদিন আগে ফাঁস হওয়া একটি অডিওতে শেখ হাসিনার মতো কণ্ঠস্বরে একজনকে বলতে শোনা গিয়েছিল, আমি খুব কাছাকাছিই আছি, যাতে চট করে ঢুকে পড়তে পারি। গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর, আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীও হয়তো ভাবছেন, তাদের নেত্রীর দেশে ফেরা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা!

তবে শেখ হাসিনা এই মুহূর্তে যে দেশের আতিথেয়তায় আছেন তারা কিন্তু এখনই অতটা আগ বাড়িয়ে ভাবতে রাজি নয়। সাউথ ব্লকের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার কথায়, পরিস্থিতি এখনো প্রতিকূল, বল উল্টোপাল্টা লাফাচ্ছে। এরকম সময় চালিয়ে খেলতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে! এখন বরং ধৈর্য দেখানোর সময়, ফলে প্রতিপক্ষের লুজ বলের জন্য অপেক্ষা করাটাই শ্রেয়।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসএএইচ

This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!

Report

What do you think?

Written by Sultana

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

GIPHY App Key not set. Please check settings

Loading…

0

ভোলা-২ আসনের সাবেক এমপি মুকুল গ্রেপ্তার

আশা করি নতুন উপদেষ্টাদের কাজ দেখে বিচার করবেন বাংলাদেশের জনগণ!