in

৩৬ জেলায় গুমের ঘটনার তথ্য পেয়েছে কমিশন

‘আমারে চিত করে শোয়ায় দিছে। দুই হাত আর দুই পায়ের মধ্যে বাঁশ ঢুকায় দিছে। তারপর হাত-পায়ের ওপরে চারজন উঠে বসে। এরপর মুখের ওপরে একটা কাপড় দিয়ে ওপর থেকে পানি ঢালতেছিল।’

গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে নির্যাতনের এই বর্ণনা দিয়েছেন ১৯ বছর বয়সী এক তরুণ। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে র‌্যাবের হাতে গুম হন। পরে তাঁকে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘…ওই মাইরটা আমি নিতে পারতেছিলাম না। আমার মনে হয় যে সেকেন্ডের মধ্যে আমি মারা যাব, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।’

ওই তরুণের দেওয়া জবানবন্দি উঠে এসেছে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে। কমিশন বলছে, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এভাবে অনেক মানুষকে যে গুম করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ৩৬ জেলায় গুমের ঘটনার তথ্য পেয়েছে কমিশন।

গতকাল বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। তদন্ত কমিশনের প্রধান বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিশনের সদস্য নূর খান, সাজ্জাদ হোসেন ও নাবিলা ইদ্রিস এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

বাসস জানায়, কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ এসেছে। তার মধ্যে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাই–বাছাই শেষ হয়েছে। তবে অভিযোগের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। কারণ, গত মঙ্গলবার পর্যন্তও কমিশন নতুন অভিযোগ পেয়েছে।

প্রতিবেদন গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘কী ভয়াবহ একেকটি ঘটনা! আমাদের সমাজের “ভদ্রলোকেরা”, আমাদেরই আত্মীয়-পরিজনেরা এ ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। আপনারা যা যা কিছু পেয়েছেন, তার ভিত্তিতে একটি হরর মিউজিয়াম হওয়া উচিত। গা শিউরে ওঠার মতো ঘটনা। এই ধরনের বন্দিশালা কেমন হয়, তিন ফুট বাই তিন ফুট খুপরির মধ্যে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আটকে থাকার যে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার চিত্র মানুষের কাছে তুলে ধরা উচিত।’

কমিশন সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা ভয়ভীতি, নানারকম হুমকি উপেক্ষা করে কাজ করে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে যারা মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করবে আপনারা তাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।’ তিনি আরও বলেন, গুম–সংক্রান্ত প্রতিবেদন ওয়েবসাইট ও বই আকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। এটি ঘিরে শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিকভাবেও আগ্রহ রয়েছে।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৭ আগস্ট কমিশন গঠন করে। গত ১৪ ডিসেম্বর ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ (সত্য উন্মোচন) শীর্ষক প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয় গুম–সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। সেখানে গত ১৫ বছরে সংঘটিত বিভিন্ন গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায় গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।

গুমের ‘মেইন কালপ্রিট’

ক্মতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে হওয়া গুমের ঘটনায় র‌্যাবের গোয়েন্দা সংস্থা সবচেয়ে বেশি জড়িত ছিল বলে গুম–সংক্রান্ত কমিশনের তথ্যে উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘গুম হয়েছে যারা, তার মেইন কালপ্রিট, মানে কিলার ফোর্স…এটা হচ্ছে র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইং (গোয়েন্দা শাখা)। তারা এ কাজটায় সবচেয়ে বেশি ইনভলবড ছিল।’
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন শফিকুল আলম। তিনি বলেন, গুমের ঘটনা দেশবাসীকে জানাতে একটি ওয়েবসাইট করা হচ্ছে।

শফিকুল আলম বলেন, গুমের ঘটনায় জড়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সরকারি পুরস্কার, পদক ও পদায়নের জন্য এসব করতেন বলে গুম–সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে কেউ কেউ এ ধরনের কাজের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, গণভবন থেকে পাওয়া দুটি চিঠি থেকে এমন তথ্য জানা গেছে।

যাদের সম্পৃক্তত

গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততার বিষয় উঠে এসেছে। গুমের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ঘটনাগুলোতে নির্দিষ্ট আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সদস্যরা জড়িত ছিলেন। গুমের বেশির ভাগ ঘটনা সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো, বিশেষ করে পুলিশ, র‍্যাব, ডিবি ও সিটিটিসি ৬৭ শতাংশের বেশি ঘটনার জন্য দায়ী।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক ঘটনার পেছনে একাধিক সংস্থার যৌথ অভিযানের যুক্ততা রয়েছে, যা নজরদারি ও জবাবদিহির প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে। বিশেষায়িত ও গোয়েন্দা ইউনিট যেমন ডিজিএফআই ও এনএসআই প্রায়ই মূল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করে, যা সমন্বিত অভিযানের ইঙ্গিত দেয়।

স্বতন্ত্রভাবে কম হলেও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের (এনএসআই) নাম বারবার অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে একযোগে উঠে এসেছে। এই সংস্থাগুলোর উপস্থিতি সীমিত হলেও তা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!

Report

What do you think?

Written by Sultana

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

GIPHY App Key not set. Please check settings

Loading…

0

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে তীব্র যানজট

আমির-সোনালির আবেদনময়ী সেই গানের শুটিংয়ে কী হয়েছিল