দেশের অন্যতম শোবিজ তারকা ও মডেল পিয়া জান্নাতুল। তিনি আইন পেশায়ও আছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি বেশ জনপ্রিয়। ফেসবুকে তাঁর অনুসারীসংখ্যা ১৭ লাখ। ইনস্টাগ্রামে ১১ লাখ।
পিয়া নিজের মডেলিং–জীবনের পাশাপাশি নানা সময় সামাজিক ও আইনি পরামর্শমূলক পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেন। তবে তাঁকে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের প্রচারণা চালাতেও দেখা গেছে। গত ১ জানুয়ারি থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ১২টি অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের প্রচারণা চালিয়েছেন নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে।
শুধু পিয়া নন, চিত্রনায়িকা শবনম বুবলী, অভিনয়শিল্পী সামিরা খান মাহিও অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন। দেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানও আছেন এই তালিকায়।
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় টি-টোয়েন্টি লিগ আইপিএলের (ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ) নতুন মৌসুম শুরু হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের এই টুর্নামেন্ট চলবে দুই মাসব্যাপী। আইপিএলের এবারের আসরে বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটার নেই। তবে আইপিএলের নিয়ে অনলাইন জুয়ার প্রচারণা সমানে চলছে বাংলাদেশে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে ক্রিকেটের আসর আইপিএল ও বিপিএল (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ) চলাকালে তা আরও বেড়ে যায়।
গত ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারির বিপিএলের পাশাপাশি চলমান আইপিএলের সময় একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, গুগলে বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন চলছে অবাধে। বাংলাদেশের শীর্ষ তারকারা অর্থের বিনিময়ে এসব বিজ্ঞাপনের প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন।
বিষয়টি নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে সাইবার স্পেসের (পরিসর) জুয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে যদি অধ্যাদেশটি উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পায়, তাহলে এই অপরাধে জড়িত ব্যক্তিরা আইনের আওতায় আসবেন।
তারকারা ধরাছোঁয়ার বাইরে
জুয়া খেলা ও প্রচারণার অভিযোগে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবস্থা নেওয়ার খবর সামনে এসেছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিন ইউটিউবারকে জুয়ার প্রচারণার অভিযোগে পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা করে গ্রেপ্তার করেছিল। তবে জুয়ার প্রচারণার চালিয়েও দেশের শীর্ষ তারকারা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো সংস্থাকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
মডেল পিয়া বিপিএলের গত আসরে অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন। এ ছাড়া আইপিএলের চলমান আসরে তিনি অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
পিয়ার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ‘বাবু ৮৮’ ও ‘ভাগ্য’ নামের দুটি অনলাইন জুয়ার প্রতিষ্ঠানের ১২টি প্রচারণা চালিয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পিয়া কোনো কথা বলবেন না বলে প্রথম আলোকে জানান।
চিত্রনায়িকা শবনম বুবলী নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে চলতি বছর ‘মেগা ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি জুয়ার প্রতিষ্ঠানের তিনটি বিজ্ঞাপন প্রচার করেছেন। এ ব্যাপারে জানতে বুবলীকে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে কল করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।
অভিনয়শিল্পী সামিরা খান মাহি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে চলতি বছর ‘বাবু ৮৮’ নামের জুয়ার দুটি প্রচারণা চালিয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চেয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, মাহিয়া মাহিসহ দেশের শীর্ষ অনেক তারকা বিভিন্ন সময় অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন।
ক্রিকেট ঘিরে অনলাইন জুয়ার প্রচার-প্রচারণায় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নাম একাধিকবার এসেছে। ১ কোটি ৬০ লাখ অনুসারী থাকা নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে গত ২২ মার্চ সাকিব ‘ওয়ানএক্সবেট’ নামের অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালান। এর আগে ২০২২ সালে ‘বেটউইনার’ নামের একটি অনলাইন জুয়ার প্রতিষ্ঠানের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেটউইনার নিউজের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি।
এ ছাড়া ভারতে বেটিং অ্যাপ (অনলাইনে বাজি ধরার অ্যাপ) কেলেঙ্কারির তদন্তে সাকিবের বোন জান্নাতুল হাসানের নাম আসে। গত বছরের মার্চে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘১১ উইকেটডটকম’ নামের একটি বেটিং অ্যাপে সাকিবের বোন বিনিয়োগ করেছেন।
সাকিব বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। অনলাইন জুয়ার প্রচারণা নিয়ে বক্তব্য জানার জন্য তাঁকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলে তিনি সাড়া দেননি।
অনলাইন জুয়ার বাজার কত টাকার
বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বাজার কত টাকার, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে দেশের কত মানুষ অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত, তার একটি আনুমানিক হিসাব গত বছরের ২৪ জুন দিয়েছিলেন তৎকালীন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক। তখন তিনি বলেছিলেন, দেশের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত।
অন্যদিকে গত বছরের ২০ জুন ভারতের সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে অবৈধ অনলাইন বাজির বাজার বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের মতো অর্থ সংগ্রহ করে।
২০২৪ সালের ১৩ মে ভারতের সংবাদমাধ্যম মিন্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭ অনুযায়ী জুয়া নিষিদ্ধ। তারপরও দেশটিতে অনলাইনে জুয়ার প্রচারণাসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ড থেমে নেই। ভারতে জুয়ার বাজার বছরে তিন বিলিয়ন ডলারের সমান হবে। বিশ্বে অনলাইন গেমিং বাজারে চীনের পরে রয়েছে ভারত। আইপিএল ও নির্বাচনের সময় ভারতে অনলাইন জুয়ার প্রসার ঘটে।
তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইট লিমিটেডের (ডিআরএল) তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাবের অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন আছে।
২০২৪ সালের এপ্রিলে ‘নীতি লঙ্ঘন: বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে মেটার প্ল্যাটফর্মে হাজার হাজার জুয়ার বিজ্ঞাপন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেসবুকের মূল এই প্রতিষ্ঠানের (মেটা) প্ল্যাটফর্মগুলোয় বছরে জুয়ার বিজ্ঞাপনে ব্যয় আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা। তবে প্রকৃত ব্যয় আরও বেশি হতে পারে।
অনলাইন জুয়ার উৎস সম্পর্কে ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট জুয়ার প্রতিষ্ঠানের ভারতীয় নাম দেখে সেগুলোকে সে দেশ থেকে আসা বলে মনে হয়। বিশেষ করে তাদের ক্রিকেটের অন্যতম বড় আসর আইপিএলের সময়ে অনলাইন জুয়া বেড়ে যায়। তবে জুয়ার সাইট বা অ্যাপ ভারত ছাড়া অন্য দেশেও হোস্ট করা থাকতে পারে।
শক্ত আইন ও তদারকি নেই
ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের প্রসারে জুয়া খেলার ধরন পাল্টে গেছে। এখন অনলাইন জুয়ার বেশির ভাগই মুঠোফোনে খেলা হয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনলাইন জুয়ার বড় বাজার গড়ে উঠছে।
বাংলাদেশে জুয়া নিষিদ্ধ। দেশে জুয়া দমনে আইন (পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭) আছে। কিন্তু আইনটি অস্পষ্ট।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, গণিকাবৃত্তি ও জুয়া খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, তার সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই।
ইন্টারনেট যুগের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিশেষ করে অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে স্পষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। তবে ২০২৩ সালের ১১ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশন, বিশেষ করে খেলার চ্যানেলসহ ডিজিটাল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অনলাইন বাজি ও জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে যেসব আর্থিক পরিষেবার মাধ্যমে বেটিং ওয়েবসাইটের অর্থ আদান-প্রদান হয়, সেগুলোর গেটওয়ে ও চ্যানেল বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
১৮৬৭ সালের ‘পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭’ রহিত করে ‘জুয়া প্রতিরোধ আইন, ২০২৩’ প্রণয়ন উদ্যোগের অংশ হিসেবে একটি খসড়া করেছিল বিগত সরকার। এই খসড়ায় অনলাইন জুয়া নিয়ে আলাদা করে বলা আছে।
প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে সাইবার স্পেসে জুয়া খেলা সম্পর্কে বলা হয়েছে, কেউ যদি জুয়ার কোনো পোর্টাল, অ্যাপ বা ডিভাইস তৈরি বা পরিচালনা করে, খেলায় অংশগ্রহণ করে, উৎসাহ প্রদান করে বা বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ করে, তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ অপরাধের জন্য ২ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হবে।
গুগল-ফেসবুক নিজস্ব নীতি মানছে না
ডিসমিসল্যাবের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান মেটার (ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান) অনলাইন জুয়া ও গেমিং বিজ্ঞাপন নীতিমালায় বলা আছে, বিজ্ঞাপনদাতাদের এ ধরনের প্রচার-প্রচারণার আগে অবশ্যই একটি ফরম পূরণ করতে হবে। যেসব দেশ মেটার তালিকাভুক্ত, সেসব দেশকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন দেওয়া যাবে।
কিন্তু মেটার অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের জন্য অনুমোদিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। ডিসমিসল্যাব বলছে, অনলাইন জুয়ার এসব বিজ্ঞাপনদাতা তাদের বিজ্ঞাপনের ধরন অস্পষ্ট করে বা মেটার শনাক্তকরণ পদ্ধতি এড়িয়ে জুয়ার প্রচারণা চালাচ্ছে।
আরেক টেক জায়ান্ট গুগলও এ ক্ষেত্রে নিজস্ব নীতির তোয়াক্কা করছে না। ডিসমিসল্যাবের আরেকটি গবেষণায় এ নিয়ে বলা হয়েছে, গুগল কিছু নির্দিষ্ট দেশে জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখানোর অনুমতি দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ এসব দেশের তালিকায় নেই। কিন্তু এরপরও জুয়ার সাইটগুলো বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।
অনলাইন জুয়ার প্রকাশ্য প্রচারণায় তারকাদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুয়া নিয়ে আইনে এখনো গ্রে এরিয়া (অস্পষ্টতা) রয়েছে। প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ হলে জুয়ার বিষয়ে জবাবদিহি আসবে বলে আশা করা যায়।’
This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!
GIPHY App Key not set. Please check settings