উম্মতে মোহাম্মাদীর সোনালী তিন যুগেও অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈনের যুগেও এই রাতের ফজিলত অর্জনের চেষ্টা করা হত। সুতরাং এটাকে বেদআত বলা ঠিক না। সঠিক কথা হল, এটা ফজিলতের রাত। এ রাতে ইবাদত করা সওয়াব অর্জনের মাধ্যম। তাই এ রাতে ইবাদতের বিশেষ গুরুত্ব আছে।
গৌরবান্বিত এই রাতে ইবাদতে কিংবা দোয়ার বিশেষ কোনও পদ্ধতি প্রমাণিত নেই যে সে পদ্ধতিতেই আমল করতে হবে। যেমন শবে বরাতে বিশেষ পদ্ধতিতে নামাজ পড়তে হবে, প্রথম রাকাতে অমুক সূরা পড়তে হবে দ্বিতীয় রাকাতে অমুক সূরা পড়তে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলোর কোনও ভিত্তি নেই। এগুলো ভিত্তিহীন কথা। বরং এই রাতে যতটুকু সম্ভব নফল ইবাদত করতে হবে। নফল নামাজ, কোরআন শরীফ পড়তে হবে। জিকির, তাসবিহ ও দোয়া করতে হবে। কিন্তু এর জন্যে বিশেষ কোনও পদ্ধতির প্রয়োজন নেই।
শবে বরাতে করণীয়:
হজরত আবু উমামা বাহেলি (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, যখন শাবান মাস আগমন করত তখন রাসূল (সা.) বলতেন, এ মাসে তোমরা তোমাদের অন্তর্জগৎকে পূতপবিত্র করে নাও এবং নিয়তকে পরিশুদ্ধ ও সঠিক করে নাও। (তাবরানি)
অন্তরকে পূতপবিত্র করার কী অর্থ? এর অর্থ হল, বেশি বেশি নেক আমল করা ও তওবা- ইস্তেগফার করা। যখন শাবান মাস আসত, রাসূল (সা.) নফল আমলের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। দিনে রোজা রাখতেন এবং রাতে দীর্ঘ সময় নামাজ পড়তেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করো ও দিনে রোজা পালন করো। (সুনানে ইবনে মাজাহ)
শবে বরাতের রাতে বিশেষ কয়েকটি আমল: বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা ২. জিকির-আজকার করা ৩. দীর্ঘসময় নিয়ে নফল নামাজ পড়া ৪. সালাতুত তাসবীহ পড়া ৫. বেশি বেশি ইস্তেগফার করা ৬. অধিকপরিমাণে চোখের পানি ঝরিয়ে নিজের জন্য, সমস্ত মুসলমানের জন্য এবং মৃত আত্মীয়-স্বজনের জন্য দোয়া করা। ৭. লায়লাতুল বরাতের পরের দিন রোজা রাখা ৮. একাকী কবর জিয়ারত করা।
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, নবীজী (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে গিয়ে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন।
বলেন, নবীজী (সা.) তাকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া-বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুণাহগারকে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ৭৩৯)
ইমাম ইবনে রজব (রহ.) বলেন, শবে বরাতে নফল নামাজের জন্য মসজিদে ভিড় করা কিংবা মাহফিল করা মাকরূহ। (নফল ইবাদাত-বন্দেগি করতে হবে নিজের ঘরে)
বলেন, একজন মুমিন বান্দার উচিত, এ রাতে জিকির ও দোয়ার জন্য পুরোপুরি অবসর হয়ে যাওয়া। উচিত হল, প্রথমে খাঁটি মনে তওবা করা; এরপর মাগফিরাত ও ক্ষমা প্রার্থনা করা; আপদ-বিপদ দূর হওয়ার জন্য দোয়া করা এবং নফল নামাজ বেশি বেশি পড়া।
সব সময় সে সব গোনাহ থেকে বিরত থাকা, বিশেষত যেগুলো এই রাতের ফজিলত (ব্যাপক ক্ষমা) থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে। যেমন- শিরক, হত্যা, জিনা, হিংসা ইত্যাদি।
(সূত্র: লাতায়িফুল মাআরিফ ফীমা লিমাওয়াসিমিল ‘আমি মিনাল ওয়াযায়েফ)
শবে বরাতে কবরস্থানে যাওয়া প্রসঙ্গ: এ রাতের আরও একটি আমলের কথা হাদিসের একটি রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত আছে। সেটি হলো, নবী করীম (সা.) এই রাতে জান্নাতুন বাকীতে গিয়েছিলেন। যেহেতু নবীজি কবরস্থানে গিয়েছিলেন। তাই অনেক মুসলমান শবেবরাতে কবরস্থানে যায়। এ বিষয়ে আমার পিতা মুফতি মুহম্মাদ শফি রহ. এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
তিনি বলেছেন, নবীজি থেকে যে কাজ যেভাবে যে পদ্ধতিতে প্রমাণিত হয়েছে সেই আমলকে সেই পর্যায়ে আর সেই পদ্ধতিতেই বাকি রাখতে হবে। এরচেয়ে অগ্রসর হওয়া যাবেনা। সুতরাং নবী করীম (সা.) থেকে কবরস্থানে যাওয়ার আমল যেহেতু একবার পাওয়া গেছে।
তাই কেউ যদি জীবনে একবার কবরস্থানে যায় তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু প্রত্যেক শবেবরাতে কবরস্থানে যাওয়া, সেটিকে জরুরি মনে করা, এই আমলকে শবেবরাতের অংশ ধরে নিয়ে ‘এটা ছাড়া শবেবরাত অসম্পূর্ণ’ মনে করা রাসূল সা. থেকে বর্ণিত নিয়মের বাহিরে চলে যাওয়ার অন্তর্ভুক্ত।
এই রাতে যা বর্জনীয়:
১. শবে বরাতের রাতে মসজিদে বিপুল পরিমাণ জনসমাগম করা যাবে না।
২. মসজিদে কিংবা বাসা-বাড়িতে অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করা যাবে না।
৩. ইবাদত মনে করে হালুয়া-রুটির আয়োজন করা যাবে না।
৪. ইবাদত মনে করে খাসি জবেহ করা যাবে না।
৫. আতশবাড়ি ও পটকা ফোটানো যাবে না।
৬. ইবাদ-বন্দেগি রেখে অপ্রয়োজনে ঘুরাফেরা করা যাবে না।
৭. কোনও গর্হিত কিংবা অশ্লীল কাজে লিপ্ত হওয়া যাবে না।
৮. এ রাতে অন্য কারও ইবাদতে বা ঘুমে বিঘ্ন সৃষ্টি করা যাবে না।
৯. সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে ক্ষমা ঘোষণার এই রাতে দল বেঁধে কবরস্থানে যাওয়া যাবে না।
GIPHY App Key not set. Please check settings