in

‘মধ্যপ্রাচ্যের সংকটে বিকল্প বাজার ও উৎস খুঁজে বের করতে হবে

ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে। এটি কেবল কয়েকটা নির্দিষ্ট খাতকে নয় বরং পুরো অর্থনীতিকে টালমাটাল করে দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের উচিত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, বিকল্প বাজার ও উৎস খুঁজে বের করা এবং প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা। ব্যবসায়ীদেরও উচিত নিজেদের সাপ্লাই চেইনকে আরও শক্তিশালী করা এবং বৈশ্বিক অস্থিরতার জন্য প্রস্তুত থাকা। মানবজাতির জন্য এমন একটি যুদ্ধের পরিস্থিতি এড়ানোই সর্বোত্তম ব্যবস্থা। কারণ এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। 

এই যুদ্ধের ফলে সারা বিশ্বে জ্বালানির সংকট তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ইরানের নিয়ন্ত্রণে থাকা হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্বের জ্বালানি তেলের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এতে করে দাম বাড়বে জ্বালানির। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বের উৎপাদন ও মূল্যের উপর। বাংলাদেশও বৈশ্বিক এই সংকট থেকে মুক্ত নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হলে গম, চিনি, ভোজ্য তেল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে। বাংলাদেশ এসব পণ্যের একটি বড় অংশ আমদানি করে। তাই আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়লে দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়কে অসহনীয় করে তুলবে। 

ইসরাইল এবং ইরানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। ভূ-রাজনৈতিক এই সংঘাত বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এই সংঘাতের সরাসরি প্রভাব না থাকলেও, এর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক তরঙ্গ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বয়ে আনবে। 

এ ছাড়া অন্যান্য প্রভাবগুলোর মধ্যে যেমন; 

তেলের দাম বৃদ্ধি এবং তার প্রভাব: মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের জ্বালানি তেলের অন্যতম প্রধান উৎস। ইসরাইল-ইরান যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে তেলের সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে এবং বিশ্ববাজারে তেলের দাম হু হু করে বাড়বে। বাংলাদেশের অর্থনীতি তেলের আমদানির উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। তেলের দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়বে, যা প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। এতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাবে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে এবং ব্যবসা পরিচালনার খরচ আকাশচুম্বী হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় লোডশেডিং বৃদ্ধি পেতে পারে, যা শিল্প উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করবে।

জাহাজীকরণ ও সরবরাহ চেইন ব্যাহত: মধ্যপ্রাচ্যের জলপথ, বিশেষ করে হরমুজ প্রণালি, বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের প্রায় ২০-৩০% তেল এই প্রণালি দিয়েই পরিবাহিত হয়। যদি এই অঞ্চল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়, তাহলে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। জাহাজীকরণের সময় বাড়বে, বীমার খরচ বাড়বে এবং অনেক রুট পরিবর্তন করতে হবে। এর ফলে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত, যেমন; তৈরি পোশাক শিল্পে কাঁচামাল আমদানি এবং পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হবে।

রেমিট্যান্স প্রবাহে আঘাত: বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। যদি এই অঞ্চলে যুদ্ধ বা অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে কর্মসংস্থান কমে যাবে, শ্রমিকদের আয় কমে যাবে এবং অনেকে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হবেন। এর ফলে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে ব্যাপক ধস নামবে, যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং ডলার সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।

বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা: বৈশ্বিক অস্থিরতা বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ করতে দ্বিধা বোধ করেন। একটি সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের ভয় তৈরি করবে, যার ফলস্বরূপ বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ আসা কমে যেতে পারে। এমনকি বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরাও তাদের বিনিয়োগ তুলে নিতে পারেন।

শেয়ারবাজারের অস্থিরতা আন্তর্জাতিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপট: ইসরাইল-ইরান সংঘাতের খবরে শুক্রবার (১৩ই জুন, ২০২৫) বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারে তাৎক্ষণিক অস্থিরতা দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ, এসঅ্যান্ডপি ৫০০ এবং মাসডাক কম্পোজিট সূচকগুলো হ্রাস পেয়েছে। ইউরোপ ও এশিয়ার প্রধান প্রধান বাজার যেমন জাপানের নিক্কেই, জার্মানির ড্যাক্স এবং ফ্রান্সের সিএসি ৪০ সূচকও নিম্নমুখী ছিল। বিনিয়োগকারীরা ‘ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বিক্রি করে সোনা, সুইস ফ্রাঙ্কের মতো নিরাপদ আশ্রয়স্থলে বিনিয়োগ করছেন। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়লে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা সাধারণত এমন দেশগুলো থেকে তাদের বিনিয়োগ তুলে নেন যেখানে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ঝুঁকি বেশি বলে মনে হয়। যদিও বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের সঙ্গে বৈশ্বিক বাজারের সরাসরি সংযোগ তুলনামূলকভাবে কম, তবুও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও অনুভূতির উপর বৈশ্বিক পরিস্থিতির বড় প্রভাব পড়ে। ইসরাইল-ইরান সংঘাতের ওয়েভ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও অনুভূত হবে। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি শুরু করতে পারেন, যার ফলে বাজার সূচক দ্রুত নিচে নেমে যাবে এবং বাজারের স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ কমে যাবে এবং স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও সতর্ক অবস্থানে চলে যাবেন।

পণ্যের চাহিদা ও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস: বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি হলে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো আমাদের প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। এর ফলে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা কমে যাবে, যা আমাদের রপ্তানি খাতকে আরও দুর্বল করবে। বিশ্বজুড়ে বেকারত্ব বাড়লে ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হলে বিলাসবহুল পণ্যের চাহিদা কমবে, যার প্রভাব আমাদের অপ্রচলিত রপ্তানি খাতগুলোতেও পড়বে।

This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!

Report

What do you think?

Written by Sultana

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

GIPHY App Key not set. Please check settings

Loading…

0

খুচরা বাজারে চড়া চালের দাম, ডিম-মুরগিতে স্বস্তি!

১২ দিনের সংঘাতে ১৪ ইরানি বিজ্ঞানী নিহত, দাবি ইসরায়েলের