বাংলাদেশি তরুণীকে বিয়ে করে ঘর বাঁধার স্বপ্নপূরণ হলো না চীনা যুবকের। হান কিংগু (৩২) নামের এই যুবক স্ত্রীকে নিয়ে স্বদেশে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বাড়ি ফেরা হলো না তার। বাংলাদেশের মাটিতেই শেষ সমাধি হয়েছে হাজার মাইল দূরের এই চীনা যুবকের।
ভিনদেশি (বাংলাদেশি) নতুন বউয়ের অপেক্ষায় থাকা তার চীনা পরিবার সন্তানের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পাশে দাঁড়ালেও তাকে আর বাঁচাতে পারেনি। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ছেলের মরদেহ দাফন করে (চীনে) ফিরে গেছেন তারা। অপরদিকে বিয়ের মেহেদীর রং না শুকাতে স্বামীকে (চীনা যুবক) হারানোর বেদনায় মূর্ছা যাচ্ছেন মোংলা পৌর শহরের কাজল আক্তার (২০)।
তার দাবি, মোটা অংকের চাঁদা না পেয়ে দালাল চক্র পরিকল্পিতভাবে তার সদ্য বিবাহিত স্বামী চীনা যুবককে হত্যা করে দুর্ঘটনা বলে প্রচারণা ও ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোংলা পৌর শহরের কলেজ রোড এলাকার বাসিন্দা ও দালাল জোহন হালদারের মাধ্যমে চীনের হেনান প্রদেশের বাসিন্দা হান কিংগু (২৫) বাংলাদেশে আসেন। তার বাড়ি চীনের হেনান প্রদেশের ঝংমু কাউন্টি ও হানসি শহরের জিয়াগুহান গ্রামে। বাবা হান সিনহে পেশায় একজন ব্যবসায়ী। দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তান তার। তিন সন্তানের মধ্যে হান কিংগু সবার ছোট ও একমাত্র পুত্র।
পরিবারের কাছে হানের আবদার ছিল বাংলাদেশে বেড়াতে আসা। পরিবারও আপত্তি করেনি, এক মাসের ভিসা নিয়ে গত ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন। পূর্বের লিংকে এই চীনা যুবক প্রথমে মোংলার বাসিন্দা দালাল জোহন হালদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। পরে তার মধ্যস্থতায় চীনা যুবক মোংলায় আসেন। এখানে পৌর শহরের বাসিন্দা ভ্যানচালক ইব্রাহিম চকিদারের মেয়ে কাজল আক্তারকে বিয়ে করতে সম্মত হন।
ধর্মান্তরিত হয়ে (মুসলিম) গত ১৭ এপ্রিল ঢাকায় তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। পরে চীনা যুবক স্ত্রী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে মোংলায় শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করেন। বেশ ভালোই কাটছিল ভিনদেশি যুবক ও বাংলাদেশি তরুণীর জীবন।
বিয়ের দুই সপ্তাহ পার না হতেই কাজল আক্তারের ভ্যানচালক বাবার কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করে দালাল জোহন হালদার। নয়তো ভিনদেশি যুবকের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের হুমকি দেওয়া হয়। আর এ নিয়ে কানাঘুষার মধ্যে এ ঘটনা চীনা যুবকের কানে পৌঁছায়।
চীনা যুবক সদ্য বিবাহিত স্ত্রী ও তার পরিবারকে জানায়, এ বিয়ে বাবদ দালাল তার কাছেও ৫ লাখ টাকা দাবি করেছে। অগ্রিম নিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা। বাকি টাকা পরবর্তীতে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন চীনা যুবক। দালালের পরামর্শে প্রথমে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি চীনা যুবক গোপন রাখে স্ত্রী কাজলের পরিবারের কাছে।
একপর্যায়ে চীনা যুবক ও তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর পরিবারের কাছে জানাজানি হয় অর্থ লেনদেনের বিষয়টি। এ নিয়ে দালাল জোহন হালদার ও তরুণী কাজলের পরিবারের মধ্যে বাগবিতণ্ডা ও মনোমালিন্য হয়। এ অবস্থার মধ্যে সদ্য বিবাহিত স্ত্রী কাজল আক্তারকে সঙ্গে নিয়ে নিজ দেশে ফেরার আগ্রহ ও নিজের ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য গত ৬ মে দালাল জোহান হালদারকে নিয়ে ঢাকায় যান চীনা যুবক। এদিন সকালে মোংলা থেকে ঢাকায় পৌঁছে ভিসা প্রক্রিয়ার প্রাথমিক শেষ করে শ্বশুরবাড়ি মোংলায় ফেরার কথা ছিল তার। ঢাকায় অবস্থানকালে চীন থেকে ব্যবসায়ী বাবা ৩ লাখ টাকা পাঠান। ব্যাংক থেকে সেই টাকা উত্তোলন করেন চীনা যুবক হান কিংগু।
এদিন দুপুরে স্ত্রী কাজল আক্তারের সঙ্গে ফোনে এমন কথা হয় তার। কিন্তু বিকাল গড়াতে দালাল জোহন ভিনদেশি যুবকের সঙ্গে শুরু করে নানা নাটকীয়তা। পরিবহণের গাড়ি না পাওয়ার অজুহাতে কালক্ষেপণ করে কখনো হোটেলে, আবার কখনো দালালের নিজস্ব আত্মীয় বাড়িতে রাতযাপনের কথা বলা হয় তাকে। রাত সাড়ে ৮টায় বাহিরে রাতের খাওয়া শেষে জোহন হালদার তাকে নিয়ে ঢাকার সোনারগাঁয়ে কাঁচপুরে কবরস্থান রোড এলাকার জনৈক আশরাফ মাস্টারের ভাড়াটিয়া জোহনের শ্যালিকা সুনিতার হালদারের বাসায় ওঠেন।
আধো আধো বাংলায় কথা বলতে পারা চীনা যুবক এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ওই রাত ১১টায় কাজল হোয়াটসঅ্যাপে স্বামী চীনা যুবককে ভিডিও ফোন করেন। কথা শেষে ঘুমিয়ে পড়েন কাজল আক্তার। পরদিন (৭ মে) ভোর সাড়ে ৫টায় সোনারগাঁও থানা পুলিশ কাঁচপুর নয়াবাড়ি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন চীনা যুবককে। প্রথমে তাকে দি বারাকাহ ও মনপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
একপর্যায়ে চীনা দূতাবাসসহ পরিবারের কাছে খবর পৌঁছায়। নিকটাত্মীয় চীনা দূতাবাসের লিংকে খবর পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছায় মোংলার তরুণী কাজল ও তার পরিবার। চীনা যুবককে শনাক্ত করে কাজল ও তার পরিবার। পরে চীনা দূতাবাস ও কাজলের ফোন কল পেয়ে চীন থেকে ৮ মে ছুটে আসেন তার বাবা। আর ১২ মে দুই বোন বাংলাদেশে আসেন। হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা সন্তান তখন কোমায়। এখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। চীনা দূতাবাসের মধ্যস্থতায় তাকে দাফন করা হয় উত্তরার একটি কবরস্থানে।
চীনা যুবকের স্ত্রী (মোংলার) কাজল আক্তার জানান, জোহন হালদারের শ্যালিকা সুনিতা হালদার পরিকল্পিতভাবে তার স্বামীকে হত্যা করেছে। যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে বলে দাবি কাজল পরিবারের।
এ ঘটনায় গত সোমবার (১৯ মে) নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন কাজল আক্তার।
এ বিষয়ে মোংলার জোহন হালদার বলেন, চীনা যুবক তার সঙ্গে ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন। আর রাতে শ্যালিকা সুনিতার ভাড়া বাসায় অবস্থান করছিলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে চীনা যুবক হান কিংগুকে বিছানা ও রুমে দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন বলে জানায় জোহন হালদার। তবে বিয়ের জন্য দালালি বাবদ অর্থ লেনদেনসহ চীনা যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় নিজের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মফিজ উদ্দিন মোবাইল ফোনে বলেন, গত ৭ মে সকালে সোনারগাঁও থানা পুলিশ কাঁচপুর নয়াবাড়ি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় চীনা যুবক হান কিংগুকে উদ্ধার করে পুলিশ। তার মুখমণ্ডল ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ঘটনায় একটি নিয়মিত মামলা হয়েছে এবং পুলিশ তদন্ত করছে।
উল্লেখ্য, মোংলার নারকেলতলা গ্রামের বাসিন্দা জনৈক নারী মেরিনা হালদারের (বর্তমানে চট্টগ্রামের বাসিন্দা) মাধ্যমে জোহন হালদারের দুই কন্যা ও শ্যালিকার মেয়ের চীনা নাগরিকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর থেকে (দুই কন্যা ও শ্যালিকার মেয়ে) তারা চীন দেশে অবস্থান করছেন। তাদের মাধ্যমে চীনা যুবকরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় এসে চুক্তিভিত্তিক বাংলাদেশি তরুণীদের বিয়ে করেছেন। মোংলা উপজেলায় অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন চীনা যুবক এ প্রক্রিয়ায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন বলে জানা গেছে। এমন বিয়ের মাধ্যমে একাধিক চীনা যুবক বর্তমানে মোংলায় অবস্থান করেছেন।
This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!
GIPHY App Key not set. Please check settings