বিশুদ্ধ পানির অন্যতম উৎস ভূগর্ভস্থ তথা মাটির নিচে জমে থাকা পানি। বিশ্বের ৯৭ শতাংশ বিশুদ্ধ পানি আহরিত হয় মাটির তলদেশ থেকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রাত্যহিক জীবনে খাওয়ার পানি, রান্না, ধোয়ামোছা ও গোসলের কাজে শতভাগ প্রয়োজন পড়ে এ পানির। উপকূলীয় গ্রামীণ অঞ্চলে আমরা নলকূপ চাপলেই যে পানির নিত্য দেখা পাই তা ভূগর্ভস্থ পানি। কিন্তু আশঙ্কার বিষয়, দেশে ভূগর্ভস্থ ওই পানিতে এবার প্রথমবারের মতো ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এই কণা দীর্ঘমেয়াদে হরমোনজনিত সমস্যা, ক্যানসার এবং প্রজননক্ষমতা হ্রাসের কারণ হতে পারে। যা মানবদেহে স্বাস্থ্যঝুঁকির নতুন সংকেত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা।
সম্প্রতি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ও সামুদ্রিক বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন এবং তাঁর গবেষণাদল ভূগর্ভস্থ পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করেন। তাঁরা বাংলাদেশের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর এবং পটুয়াখালী জেলার ১৮টি স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন। যাতে দেখা যায়, ভূগর্ভস্থ পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের মাত্রা ৪ থেকে ৭৫টি কণার মধ্যে পরিবর্তিত হয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, ওই ছয় উপকূলীয় জেলার ভূগর্ভস্থ পানিতে লিটারপ্রতি গড়ে ২৪.৬৩টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া যায়, যা প্রথমবারের মতো ভূগর্ভস্থ পানিতে পাওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিকের অবস্থান ও তার প্রাণঘাতী স্বাস্থ্যঝুঁকির তথ্য দেয়। মানবশরীরে এই কণার দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি হরমোন সমস্যা, ক্যানসার সৃষ্টি ও প্রজননক্ষমতা কমাতে পারে বলে জানান তাঁরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ মতে, একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি যদি দৈনিক ৪.৫ লিটার পানি পান করেন, তবে বছরে প্রায় ৪০ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গ্রহণ করতে পারেন। সে বিবেচনায় যেখানে বাংলাদেশের গ্রাম থেকে শহরের বাসিন্দারা পুরোপুরি ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। সেখানে একজন বাংলাদেশি বছরে নিজের অজান্তে কতসংখ্যক মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গ্রহণ করছেন? এটি তাঁদের নিজের অজ্ঞাতেই স্বাস্থ্যহানির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
যদিও মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের নেতিবাচক প্রভাব পুরোপুরি জানা যায়নি, তবুও এটি শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলে জানান গবেষকেরা। কারণ, তাঁরা মাইক্রোপ্লাস্টিকের সঙ্গে প্রায়ই কীটনাশক, ভারী ধাতু, পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন (পিএএইচএস), বিসফেনল এ (বিপিএ), থ্যালেট এবং ফ্লেম রিটারড্যান্ট এমন ক্ষতিকর রাসায়নিক ও দূষণ পেয়েছেন। যেগুলো শরীরে প্রবেশ করে মানবদেহে টিস্যু ক্ষতি, হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট, প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষতি, ক্যানসারের ঝুঁকি, ইমিউন সিস্টেমে দুর্বলতা তৈরি করতে পারে বলে জানিয়েছে গবেষকদল। নদী-নালার দেশ হলেও বাংলাদেশে পানির সমস্যা রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোয় পানির অভাব তীব্র হয়। কোথাও কোথাও তৃষ্ণার্ত মানুষকে ঘটি-বাটি নিয়ে মিছিলে নামতেও দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে, যদি এ শতাব্দীতে তেল নিয়ে যুদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে আগামী শতকে সেই যুদ্ধ হবে পানি নিয়ে। ব্যাবিলনীয় রাজা হাম্বুরাবির শাসনকাল থেকে এখন পর্যন্ত পানি নিয়ে ছোট-বড় ৯২৫টি সংঘাতের তালিকা পাওয়া যায়। কাজেই পানি এবং সংঘাতের মধ্যে এক জটিল রাজনৈতিক অর্থনীতির সম্পর্ক রয়েছে।
সুইজারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত জার্নাল ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স’-এ প্রকাশিত গবেষণায় গবেষক ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের অজানা সত্য উন্মোচন করেন। তাঁর গবেষণায় ৯৭.৬ শতাংশ মাইক্রোপ্লাস্টিক ফাইবার আকারে পাওয়া যায়, যা কাপড় ও প্লাস্টিকপণ্যের ক্ষয় থেকে উৎপন্ন। প্রাপ্ত কণাসমূহের মধ্যে প্রধান উপাদান ছিল পলিথিন, যা প্লাস্টিক ব্যাগ, প্যাকেজিং এবং জালের মাধ্যমে আসে। অধিকাংশ মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা ০.৫ মিমি বা তার চেয়ে ছোট আকারের, যা মানবদেহে সহজেই প্রবেশযোগ্য। সর্বাধিক কণা পাওয়া যায় কক্সবাজার ও চাঁদপুর জেলায়। ওই অঞ্চলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকপণ্য, কাপড় ধোয়ার ফাইবার এবং মাছ ধরার জালের টুকরা। এ ছাড়া পলিয়েস্টার, নাইলন, অ্যাক্রাইলিক এবং অন্যান্য সিনথেটিক উপাদানের পোশাক থেকে মাইক্রোফাইবার বের হয়ে আসতে পারে। যখন এই ধরনের পোশাক ধোয়া হয়, তখন মাইক্রোফাইবার পানির মাধ্যমে বের হয়ে ভূগর্ভস্থ জলাশয়ে পৌঁছাতে পারে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানির একটি নতুন ও উদ্বেগজনক সমস্যা। এ দূষণ নিয়ন্ত্রণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, অন্যথায় এটি জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ উভয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আমাদের দেশে যেখানে প্লাস্টিকের ব্যবহার বহুমাত্রিক, সে বিবেচনায় প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্ব্যবহার ছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির এ দূষণ রোধ কঠিন। উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে এ গবেষণা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। উপরন্তু এ গবেষণা স্থানীয় জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে এবং নীতিনির্ধারকদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে গবেষকদল।
This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!
GIPHY App Key not set. Please check settings