in

দ্বন্দ্ব-আধিপত্যে উত্তপ্ত পাহাড়!

গত এক দশকে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক সংগঠনের। অস্থিতিশীল পাহাড়কে শান্ত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সাথে শান্তি চুক্তি করে আওয়ামী লীগ সরকার।

মূলত শান্তিচুক্তির পরেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এসব সংগঠন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে— জেএসএস সংস্কার, ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক, মগ লিবারেশন পার্টি ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এসব সংগঠনের সদস্যরা নিজের দ্বন্দ্ব আর আধিপত্য বিস্তারের জেরে নিজেদের মধ্যে গুম, খুন, চাঁদাবাজিসহ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতেও পিছপা হচ্ছে না।

আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এ বছরের ১৯ এপ্রিল রুমা উপজেলার বড়থলি পাড়া আর্মি ক্যাম্পের আওতাধীন পলি পাংশা পাড়ার মধ্যবর্তী স্থানের যাত্রী ছাউনি এলাকায় কেএনএফের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর কর্পোরাল রফিকুল ইসলাম নিহত হন।

এর আগে, ২ এপ্রিল রুমায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি করে প্রায় দেড় কোটি টাকা লুট করে। এরপরের দিন দুপুরে পুনরায় থানচিতে কৃষি এবং সোনালী ব্যাংকের দুটি শাখায় ডাকাতির চেষ্টা চালায়। ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ছাড়াও সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজারকে অপহরণ, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর প্রায় ১৪টি অস্ত্র লুট করে হামলাকারীরা। পরে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে ম্যানেজারকে মুক্তি দেওয়া হয়।

২০২৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কেএনএফের হুমকির মুখে বান্দরবানের থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। আর ১৩ ফেব্রুয়ারি কেএনএফ সদস্যরা চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় উহ্লাচিং মার্মাকে গুলি করে আহত অবস্থায় ফেলে যায়।

উগ্রবাদী সংগঠন জামাআতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকিয়ার সদস্যদের পাহাড়ে প্রশিক্ষণ দেয় কেএনএফ। এমন তথ্য পেয়ে কেএনএফের আস্তানায় অভিযান চালানো হয়। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালানো ওই অভিযানে ২০ জনকে আটক করা হয়। যার মধ্যে ১৭ জনই ছিলেন জামাআতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকিয়ার সদস্য। ওই সময় অস্ত্র ও বোমা তৈরির সরঞ্জামের পাশাপাশি একে-২২ রাইফেলও উদ্ধার করা হয়।

আলোচনায় রয়েছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টও (ইউপিডিএফ)। তাদের সাথে সম্প্রতি অন্যান্য গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব-সংঘাত চরমে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে এ সংগঠনের সাথে জেএসএস ও নব্য মুখোশধারী বাহিনীর (ইউপিডিএফ–গণতান্ত্রিক) সাথে হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।

এসব কারণে ভয়, উৎকণ্ঠা ও শঙ্কায় দিন যাপন করছেন পাহাড়ে বসবাসকারীরা। পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে সন্ত্রাসী দলগুলোর কাছে থাকা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা জরুরি বলে মনে করেন তারা।

বান্দরবানের স্থায়ী বাসিন্দারা বলেন, আগে সবাই সহাবস্থানে থেকে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেছি। বর্তমানে সেটা আর নেই। দিন দিন পাহাড়ে চাঁদাবাজি বেড়েছে। নতুন নতুন সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি হচ্ছে। এদেরকে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে বান্দরবানে ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।

নিজেদের অন্তর্কোন্দল ও ভাতৃঘাতী সংঘাতে গেল দুই বছরে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে প্রাণ হারিয়েছেন ৩০ জনের বেশি মানুষ। পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ না নিলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত আরও বাড়বে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

পাহাড়ে মূলত নিজেদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। পাহাড়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এখানে টাকার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। টাকার লোভেই একের পর এক আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন তৈরি হচ্ছে। নিজ নিজ সম্প্রদায়ের কয়েকজন একত্র হয়েই তৈরি করছেন সংগঠন। আর নিরাপত্তার নামে গুম, খুন, চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে এসব সংগঠন। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে সংগঠনগুলো। নিজেদের মধ্যে সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বান্দরবানের এক বিশিষ্টজন বলেন, পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সম্প্রতি বান্দরবানে চাঁদাবাজি, গুম, খুন বেড়েছে। মূলত চাঁদা আদায় ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে আঞ্চলিক সংগঠনগুলো। অরক্ষিত সীমান্তের কারণে পাশের দেশ থেকে অবাধে অস্ত্র আসছে। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর হস্তে এসব চাঁদাবাজি, গুম, খুন বন্ধ করা না গেলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে। 

এ বিষয়ে পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফের (সংস্কার) বান্দরবান জেলা সভাপতি উবামং মার্মা বলেন, পাহাড়ে ভূমি বিরোধীদের কারণে সংঘাত লেগেই আছে। শান্তিচুক্তির কিছু কিছু ধারা বাস্তবায়ন হলেও এখনো অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা চাই পাহাড়ে সংঘাত নিরসনের লক্ষ্যে দ্রুত শান্তিচুক্তির অন্যান্য ধারাগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা হোক। তাহলে পাহাড়ে আগের মতো শান্তি ফিরে আসবে। 

বান্দরবানের পুলিশ সুপার শহিদুল্লাহ কাওছার বলেন, পাহাড়ে সার্বিক নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় থানা, ফাঁড়ি ও তদন্ত কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। জেলাজুড়ে নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।

তিনি বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় পুলিশ সর্বোচ্চ তৎপর রয়েছে। নতুন নতুন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। যাতে করে কোনো সন্ত্রাসী মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে।

This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!

Report

What do you think?

Written by Sultana

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

GIPHY App Key not set. Please check settings

Loading…

0

রাজধানীতে ভবন থেকে পড়ে গৃহবধূসহ ২ জনের মৃত্যু