in

সংস্কার কমিশন-ইসি দ্বন্দ্ব

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) একটি রুটিন কাজ। এ জন্য একটি আইনও রয়েছে। তবে অতীতে সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানদের কাছে নির্বাচন কমিশনের পরাভূত হওয়ার নজির আছে। তাই নির্বাচন কমিশন চায় আইনের ত্রুটিগুলো শুধরে নিজের ক্ষমতা আরও সুসংহত করে ত্রুটিমুক্ত সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে। তবে এতে বাদ সেধেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ। এই কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজটি পৃথক কর্তৃপক্ষের হাতে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ অবস্থায় সংস্কার কমিশন যখন ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত সুপারিশ প্রদানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার আগেই সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষমতা নিজের হাতে রেখে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে ইসি।

জানা গেছে, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন যুক্তরাজ্যসহ উন্নত গণতান্ত্রিক চর্চার দেশগুলোর উদাহরণ টেনেছে। তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য উন্নত দেশের প্রেক্ষাপট আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। একই সঙ্গে ভালো চর্চা গণতন্ত্রের জন্য শুভকর বলেও মনে করেন তারা।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের নির্বাচনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে সংস্কার কমিশন গঠন করে। এরই মধ্যে কমিশন বিভিন্ন সেক্টরের লোকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি সংস্কার প্রস্তাব বা সুপারিশমালা প্রস্তুত করেছে। এর মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের অনেক জায়গায় মিলে যাওয়ায় পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়ার সময় নিয়েছে। তবে এরই মধ্যে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার ও কমিশনের অন্য সদস্যরা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সুপারিশের কিছু কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন। এই সুবাদে প্রস্তাবিত প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্ত অংশের কিছু বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন।

এরপর থেকে শুরু হয় পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি-তর্ক। যেহেতু মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যে পুর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেবে, তাই নির্বাচন কমিশন (ইসি) তরিঘড়ি করে সীমানা পুনর্নির্ধারণও ভোটার তালিকা হালনাগাদ করণ সম্পর্কিত আইন পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের তৃতীয় সভায় সীমানা পুনর্নির্ধারণ এবং ভোটার তালিকা আইন ও পর্যবেক্ষণ নীতিমালাসহ ১১টি বিষয়ে আলোচনা হয়।

কমিশন বৈঠকের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আমরা সীমানা নির্ধারণ করতে চাচ্ছি ভৌগোলিক আয়তন, অবস্থান ও সর্বশেষ জনশুমারি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। এর কারণ ব্যাখা করে তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে শহরমুখী প্রবণতা রয়েছে। জনসংখ্যা ভিত্তি ধরলে শহরের দিকে আসন বাড়বে, অন্য এলাকায় কমবে। এতে সঠিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় না। নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণবিষয়ক আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর দুটি বিষয় সমস্যা সৃষ্টি করছে। মূলত জনসংখ্যায় গুরুত্ব দিয়ে এই সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে।

আইনে কী আছে : জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণী আইন-২০২১ এর ধারা ৬ এ আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- কমিশন প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনা করে প্রতিটি আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করবে, যাতে প্রতিটি আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার ভৌগোলিক অখ-তা বজায় থাকে এবং এই রূপ সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সর্বশেষ আদমশুমারি প্রতিবেদনে উল্লিখিত জনসংখ্যার, যতদূর সম্ভব, বাস্তব বণ্টনের ভিত্তিতে করতে হবে।

আইন সংশোধনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আইনের একটি উপধারায় ‘করণিক ত্রুটি’ রয়েছে। ফলে নির্বাচন কমিশন কিছুই করতে পারবে না। আসলে সেটা হওয়ার কথা নয়। আমরা সমস্যাটি তুলে ধরে সংশোধনের জন্য লিখব।

এত দিন সীমানা পুনর্নির্ধারণে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হতো : সংসদীয় আসন বণ্টন বা পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়, তা হলো জনসংখ্যা, প্রশাসনিক অখ-তা ও ভৌগোলিক অবস্থান। যেহেতু জনগণের প্রতিনিধি বাছাইয়ের জন্য এই নির্বাচন, সেহেতু এক আসন থেকে আরেক আসনের জনসংখ্যার তারতম্য আকাশ-পাতাল হতে পারে না। তবে এ ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের জনসংখ্যার বিন্যাস এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক বৈশিষ্ট্যের বিষয়টিও মাথায় রেখে নির্ধারণ করা হতো।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন যেভাবে চাইছে : সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রণীত আন্তর্জাতিক অনুসরণীয় নীতিমালার আলোকে সংস্কার কমিশন সীমানা নির্ধারণ করার কথা বলেছে। এতে ভবিষ্যতে সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি আলাদা স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে মতানৈক্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন, কমিশন যেভাবে বলছে বিষয়টি তেমন না। এটা ভুল বোঝাবুঝি থেকেই বলছে। তিনি বলেন, দুনিয়াজুড়ে তিন ধরনের প্রতিষ্ঠান সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে। এগুলো হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, সংসদ ও আলাদা একটি কর্তৃপক্ষ। সীমানা নির্ধারণ একটা কারিগরি কাজ। এটা করার ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন লোক দরকার হয়। যেমন- ভূগোলবিদ, জনমিতিকার, পরিসংখ্যানবিদ। দুনিয়াজুড়ে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে আলাদা কর্তৃপক্ষ দিয়ে করানো। ইংল্যান্ড, ভারত, ভুটান ও শ্রীলঙ্কায় আলাদা কমিশনের মাধ্যমে কাজটি করানো হয়। নির্বাচন কমিশন করলে বিতর্ক হয় এবং নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এই সদস্য বলেন, আগে কারসাজি করে সীমানা পরিবর্তন করা হয়েছে। কারও কারও অনুরোধে, সুপারিশে বা টেলিফোনে কাজগুলো হতো। তাতে ইসি বিতর্কের মধ্যে পড়ে যায়। তাই আমরা সুপারিশ করেছি, বিশেষজ্ঞ কমিটি দিয়ে করানোর জন্য।

আড়াইশ’ আবেদন : আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে এরই মধ্যে ৪১টি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের জন্য ২৪৮টি আবেদন জমা পড়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মধ্যে ইসির আইন সংশোধন প্রস্তাব কোনো জটিলতা তৈরি করবে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের এখান থেকেও কোনো ইনপুট দেওয়া হলে সেটা আরও কাজে দেবে। এখানে বিরোধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সংস্কার কমিশনের সুপারিশের কারণে কাজ বিলম্বিত হচ্ছে না মন্তব্য করে সানাউল্লাহ বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা করছি, আমাদের দ্রুত এটা প্রয়োজন। আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যে আছি। সংস্কারটা জনগণের দাবি। আমরাও এর বাইরে নই। সীমানা নির্ধারণ আইনের বিষয়ে ইসি সুপারিশ আকারে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছেন কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে আমাদের কমিশনে আসুক, তারপর কমিশন মনে করলে পাঠাবে।

This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!

Report

What do you think?

Written by Sultana

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

GIPHY App Key not set. Please check settings

Loading…

0

এবার ইসি নিজেই আইন পর্যালোচনা করছে

প্রবাসীর একাধিক ভোটার কার্ড, কারাগারে নির্বাচন অফিসারসহ ২