সংবিধান, বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) সংস্কার কমিশন যেসব সংস্কারের সুপারিশ করেছে; সেগুলোর কিছু বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত মৌলিক প্রস্তাবের বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে আসার চেষ্টা করা হবে। সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে গঠিত ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর সঙ্গে বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) সংসদ ভবনের এলডি হলে দীর্ঘ আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে এ কথা জানানো হয়েছে।
আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঐকমত্য কমিশন স্প্রেডশিটে (ছক আকারে) ‘হ্যাঁ-না’ সংক্ষিপ্ত জবাব দেওয়ার জন্য যে কাগজ দিয়েছিল, তাতে অনেকটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, ‘মিসলিড’ করা হয়েছে। এজন্য, সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবের দফাওয়ারি অলোচনা করেছে বিএনপির প্রতিনিধি। গতকাল প্রথমদিনে সংবিধান, বিচার বিভাগ ও ইসি সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে অলোচনা হয়েছে। আগামী রবিবার বেলা ১১টায় আবারও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসবে বিএনপি। ঐ দিন দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হবে।
বোঝাতে চাই, বিএনপি সংস্কারের বিষয়ে কতটা সিরিয়াস: সালাহউদ্দিন
গতকালের আলোচনায় বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। আলোচনার পর সালাহউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত মৌলিক প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে আসার চেষ্টা করবে বিএনপি। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির দফাওয়ারি আলোচনা হচ্ছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিস্তারিত প্রতিবেদনে ১৩১টি প্রস্তাব থাকলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের স্প্রেডশিটে ৭০টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে শুরু করে প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ সব বিষয়ে দফায় দফায় আলোচনা করবেন তারা।
সালাহ উদ্দিন জনান, বিএনপি সংবিধান সংস্কার কমিশনের ২৫টি প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। ২৫টির মতো বিষয়ে আংশিকভাবে একমত। বাকি বিষয়গুলোতে একমত হতে পারেনি। তিনি বলেন, আমরা যেসব বিষয়ে বিস্তারিত মতামত দিয়েছি, সে বিষয়ে কমিশনকে যৌক্তিকভাবে বোঝাব এবং তাদের প্রস্তাবের বিষয়েও আমরা যৌক্তিকভাবে জানতে চাচ্ছি। যেটা যৌক্তিক, সেটা জাতির কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা সেটা অবশ্যই বিবেচনা করব।
সালাহ উদ্দিন বলেন, সংবিধান সংস্কার দিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আলোচনা শেষ না হলে পরেও। আলোচনা হবে। আমরা বোঝাতে চাই, বিএনপি সংস্কারের বিষয়ে কতটা সিরিয়াস।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, স্প্রেডশিট দেওয়া উচিত হয়নি। আমরা এর আগে। সংবিধান, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও ইসি নিয়ে বিস্তারিত মতামত জমা দিয়েছি। আজ হার্ড কপি জমা দিয়েছি। এগুলোর ওপরে বিস্তারিত আলোচনা চলছে।
বিচার বিভাগের মতামত নিয়ে প্রতিবেদনে মিস লিড করা হয়েছে দাবি করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বিস্তারিত প্রতিবেদনের ১৫০টি মতামতের মধ্যে ৮৯টির বিষয়ে মতামত দিয়েছি। বাকিগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে একমত হওয়া বা মন্তব্যসহ একমত হওয়ার কথা জানিয়েছি। হ্যাঁ-না তে মতামত চাওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদনে বিস্তর ফারাক আছে
জানিয়ে তিনি দাবি করেন, সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের সংশোধনী ব্যতিরেকে বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি করা ততক্ষণ পর্যন্ত অসাংবিধানিক হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত তা সংবিধানে গৃহীত হচ্ছে। ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা সংবিধানসম্মত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। বিচার বিভাগ কর্তৃক সংবিধান লঙ্গন সমুচিত হবে না।
বিএনপি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চায় জানিয়ে তিনি বলেন, প্রক্রিয়া যতে আইনানুগ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে হয়, সেজন্য বিস্তারিত মতামত দেব। লিখিতও দিয়েছি। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের অধিকাংশ সংবিধান সংশোধন সংক্রস্ত দাবি করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, কিছু কিছু বিষয়ে তারা এমন প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাস্তবায়ন করলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সজা বজায় থাকবে না। তিনি বলেন, আরো আলোচনা হবে। কারণ আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোচ্ছি।
বিএনপির প্রতিনিধিদলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাঈল জবিউল্লাহ, রুহুল কুদুস কাজল, মনিরুজ্জামান খান।
তারা যখন সংস্কারের ‘স’ উচ্চারণ করেননি, তখন খালেদা জিয়া ভিশন-২০৩০ দিয়েছেন: নজরুল ইসলাম খান
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলেচনার শুরুতে বিএনপির নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে নয়, বরং বিএনপি সংস্কারেরই দল, তবে সবকিছুর মূলে জনগণ। জনগণের সম্মতিতে যেন সব হয়। আর জনগণ কার মাধ্যমে সম্মতি জানায়, তা আমরা জানি। বুধবার আমরা প্রধন উপদেষ্টাকেও বলেছি-বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে নয়, বিএনপি সংস্কারেরই দল। কিন্তু কেউ কেউ নানা কথা বলেন। তারা যখন সংস্কারের ‘স’ উচ্চারণ করেননি, তখন খালেদা জিয়া ভিশন-২০৩০ দিয়েছেন।
গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমাদের সামনে আরেকবার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, আমরা তা কাজে লাগাতে চাই। আমরা এই কমিশনকে সহযোগিতা করছি, এই সরকারকে সহযোগিতা করছি, সেই প্রত্যাশা নিয়েই। যদি ঐকমত্য কমিশনের কোনো সনদ নাও হয়, বিএনপির জন্য সংস্কারের সনদ রয়েছে।
গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে: আলী রীয়াজ
বিএনপির সঙ্গে আলোচনা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র কেবল বারবার হোঁচট খেয়েছে তা নয়; একটি ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দেশে। এমন পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আবার তৈরি হোক তা আমরা কেউ প্রত্যাশা করি না। যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছে, তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াই আমাদের প্রত্যাশা।
আলেচনার শুরুতে তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় সনদ তৈরি করা, যাতে বাংলাদেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারি। আলী রীয়াজ আরো বলেন, বিএনপি সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়েছে, ভিন্ন মত নিয়ে আলোচনা করতে চাই। গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বিএনপির ভূমিকা দেশের মানুষ অবগত। তাদের ভূমিকা জনগণের কাছে প্রশংসনীয়।
আলী রীয়াজ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিএনপির একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে এ দলটি দাবি উত্থাপন করেছে, কর্মসূচি দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী শাসনের লড়াইয়ের পাশাপাশি সংস্কারের তাগিদ দিয়েছে বিএনপি। সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সামনে অগ্রসর হতে চাই। যেগুলো আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে দিয়েয়ছিলাম, তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি আন্তরিকভাবে, সুচিন্তিতভাবে তাদের মতামত জানিয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব পালনকালে বিএনপির সহযোগিতা পেয়েছি, তার জন্য আন্তরিকভাবে তাদের ধন্যবাদ জানাই।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, আমরা আশা করছি, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা এমন একটি জায়গায় পৌঁছাতে পারব-যেখান থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ও সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্দেশ করবে। ইতিমধ্যে কিছু বিষয়ে বিএনপির একমত ও ভিন্ন মত আছে। আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা আশা করি, এক জায়গায় আসতে পারব। টেবিলের দুই ধারে বসলেও আমরা দুপক্ষ নই।
আলোচনার সঞ্চালক ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, ফেব্রুয়ারিতে ছয়টি সংস্কার কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। এসব রিপোর্ট একটি অফিসিয়াল প্রসিডিউরের মাধ্যমে বস্তবায়ন সম্ভব। দেশের রাজনৈতিক দল, অরাজনৈতিক মহল, সিভিল সোসাইটির মতামত সাপেক্ষে এগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব। সেকারণে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে ঐ সুপারিশসমূহ পাঠানো হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সেবিষয়ে মতামত দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া মতামতের ভিত্তিতে এ আলোচনা শুরু হয়েছে। এ অলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কমিশনের পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে। আলোচনায় আরো উপস্থিত ছিলেন, ঐকমত্য কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার ওড. ইফতেখারুজ্জামান।
This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!
GIPHY App Key not set. Please check settings