in

যে কোন মূল্যে সম্প্রীতি অটুট রাখার প্রত্যয়

গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সংলাপে অংশগ্রহণ করেন           -পিআইডি

* ধর্ম-বর্ণ ও মতের পার্থক্য থাকলেও আমরা এক পরিবারের সদস্য — প্রধান উপদেষ্টা 

* দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ রয়েছি ——— হেফাজত নেতৃবৃন্দ  

* কঠিন সময়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে —– ফাদার আলবার্ট রোজারিও 

যেকোন মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন ধর্মীয় নেতারা। তারা বলেছেন, পাশের দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নেই। এদেশে মুসলমান হত্যার পরও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের ব্যাপারে আমাদের আলাদাভাবে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। যারা বিভেদ দেখানোর চেষ্টা করছেন, তাদের কথায় বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। 

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মুসলমানদের নেতা হিসেবে বৈঠকে অংশ নেন, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা আবদুল মালেক, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান, নায়েবে আমীর মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, মাওলানা মহি উদ্দীন রাব্বানী, যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মাহফুজুর রহমান, মহানগর হেফাজতের সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিবসহ শীর্ষ স্থানীয় আলেমরা। 

স্বাগত বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ধর্ম-বর্ণ ও মতের পার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশের সব মানুষ একই পরিবারের সদস্য। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগে বিমানবন্দরে দেওয়া নিজের একটি বক্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, তখন বলেছিলাম আমরা একটা পরিবার। আমাদের নানামত, নানা ধর্ম থাকবে, নানা রীতিনীতি থাকবে কিন্তু আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। এটাতে জোর দিয়েছিলাম। আমাদের শত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমরা পরস্পরের শত্রু নই। আমাদের জাতীয়তা, পরিচয়ের প্রশ্নে এক জায়গায় চলে আসি। আমরা বাংলাদেশী, এক পরিবারের সদস্য।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, শপথ গ্রহণের পরে শুনতে আরম্ভ করলাম, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। তখন মনটা খারাপ হয়ে গেল। এর পরপরই ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গেলাম। সেখানেও বললাম, আমরা একই পরিবারের সদস্য।

তিনি বলেন, সব দাবিদাওয়া বাদ দিলেও একটা দাবি পরিষ্কার আমাদের সকলের সমান অধিকার, বলার অধিকার, ধর্মের অধিকার, কাজকর্মের অধিকার। সেটা এসেছে সংবিধান থেকে। নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য, রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেটা নিশ্চিত করা।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, শুনলাম এখনো সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে।  তাই আমি সবাইকে নিয়ে বসলাম, এটা থেকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়।  

দুর্গাপূজার নিরাপত্তায় সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সেটা পুরো জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছিল। তখন তৃপ্তি পেলাম, একটু তো কাজ করেছি।

ভুল তথ্যের বিষয়ে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এখন আবার নতুন কথা, হামলা হচ্ছে, অত্যাচার শুরু হচ্ছে। বিদেশী গণমাধ্যম বলব না প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে, এটা হচ্ছে। আমি খোঁজ নিচ্ছি, কী হচ্ছে? সবদিকে দেখলাম এটা হচ্ছে না। এক খবরে বলা হচ্ছে, আরেক খবরে বলা হচ্ছে হচ্ছে না, তথ্যের মধ্যে ফারাক আছে। এটা ঠিক না। এটার অবসান হতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা যে তথ্য পাচ্ছি তা ভুল হতে পারে। তথ্যের ওপর বসে থাকার কিছুই নাই, এটার অর্থ অন্ধের মতো বসে থাকা। ভেতরে গিয়ে দেখতে হবে। খোঁজ নিতে হবে তথ্যের গরমিল কেন? তাতে ওরা যা বলছে, তা কি মিথ্যা প্রচার? না আমরা যা বলছি তা মিথ্যা প্রচার। সত্যটা কোথায়। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্যের কোনো ফারাক নেই। সেখানে সঠিক তথ্য কীভাবে পাব, সেটা আমাদের জানার। প্রকৃত তথ্য, অনেক সময় সরকারি তথ্যের ওপর ভরসা করে লাভ নেই। কর্তা যা চায়, সেভাবে বলে। আসলটা মন খুলে বলতে চাই না। আমরা আসল খবরটা জানতে চাই। সেই প্রক্রিয়াটা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। এত বড় দেশে যেকোন ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু প্রকৃত তথ্য জানতে চাই। তাৎক্ষণিক খবর পেলে যাতে সমাধান করা যায়। যেদিক থেকেই দোষী দোষীই। তাকে বিচারের আওতায় আনা সরকারের দায়িত্ব।

ড. ইউনূস বলেন, প্রথম কথাটা হলো না হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক প্রতিকারের ব্যবস্থা করা। আমি যা বলছি, তা দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করে। আমরা এক পরিবারের মানুষ হিসেবে সামগ্রিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারি। সেখানে তথ্য ও প্রতিকার হলো বড় বিষয়। তিনি বলেন, আমি পেলাম তথ্য কিন্তু প্রতিকার পেলাম না। সমস্যা হয়ে গেলে সমাধান করতে হবে। আজকের আলোচনা খোলাখুলি, আমরা সবাই আলোচনা করব। আমাদের লক্ষ্যে কোনো গোলমাল নেই। তথ্য প্রবাহ কীভাবে পাব, দোষীকে কীভাবে ধরব, যাতে সবাই সঠিক তথ্যটা পেয়ে যায়।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এমন বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে চাই, যার নাম দিয়েছি নতুন বাংলাদেশ। এটা আমাদের করতে হবে। আপনাদের কথা বলে সন্তুষ্ট করে আজকের মতো বিদায় দিলাম তা নয়। এটা দ্রুত করতে হরবে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দেখলে হবে না, আমাদের বর্তমানেই করতে যেতে হবে। সংখ্যালঘু সমস্যার বিষয়ে অবাধ, সত্য তথ্য কীভাবে সংগ্রহ করা যায়, সে বিষয়ে ধর্মীয় নেতাদের পরামর্শ চান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, কীভাবে নিরাপদে সংগ্রহ করব, যে তথ্য দিচ্ছে সে যেন বিব্রত না করে তাও নিশ্চিত হতে হবে। 

বৈঠক শেষে হেফাজত ইসলামের মহাসচিব সাজিদুর রহমান বলেন, পাশের দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নেই। এদেশে মুসলমান হত্যার পরও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। দেশের সম্প্রীতির ব্যাপারে প্রচার করুন। দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ রয়েছি। হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জুনায়েদ আল হাবিব বলেন, আইনজীবী হত্যার পর ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে পরাজিত শক্তি দেশে ঢুকতে চাইছে। এর বিরুদ্ধে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকব। 

বৈঠক শেষে শায়খ আহমাদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের ব্যাপারে আমাদের আলাদাভাবে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। যারা বিভেদ দেখানোর চেষ্টা করছেন, তাদের কথায় বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না।

রামকৃষ্ণ মিশনের মহাজন স্বামী হরি প্রেমানন্দ বলেন, বৈঠকে ধর্মীয় সম্প্রীতির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই। এই সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়েই আলোচনা হয়েছে। রমনা হরিচাঁদ মন্দিরের সহ-সম্পাদক অবিনাশ মিত্র বলেন, বাইরে থেকে বিভেদ ছড়ানো হচ্ছে। বাইরের রাষ্ট্র যাতে হিন্দুদের ওপর চড়াও না হয়। সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার হলে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের স্বার্থ হাসিল করতে পারবে না। প্রধান উপদেষ্টা সবার কথাই শুনেছেন। সে অনুযায়ী তিনি কাজ করবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। 

ফাদার আলবার্ট রোজারিও বলেন, এই মুহূর্তে দেশ কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ইসকনের ব্যাপারে হিন্দু ভাইদের মনে ক্ষোভ রয়েছে। সেই ক্ষোভ নিরসনে কাজ করতে প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি। এ সময় চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুর জামিনের ব্যবস্থা করার দাবিও জানান তিনি। অপরদিকে, বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের প্রধান উপদেষ্টা ড. সুকমল বড়ুয়া বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার কথা বলেছি। যাতে বিভিন্ন সংস্থা ও মিশন জানতে পারে, এই দেশ সম্প্রীতির দেশ।

বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয় বলেন, সবাই যেন মিলেমিশে থাকে এবং সম্প্রীতির ঐতিহ্য বজায় থাকে। ভারতের মিডিয়া কী প্রচার করলো, তা আমাদের দেখার বিষয় না। অন্যদিকে গারো পুরোহিত জনসন ম্রি বলেন, যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারকে সাহায্য করার কথাও জানান তিনি।  উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সাংবাদিকদের বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার দেশে যেই গণহত্যা চালিয়েছে তার স্বীকৃতি ভারতকে দিতে হবে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের অপতথ্য দুই দেশের সম্পর্কের জন্য হুমকি স্বরূপ। এটি দেশটিকে জানানো হয়েছে। ভারতীয় আগ্রাসনের চেয়ে আমরা নিজস্ব শক্তি কতটুকু বাড়াতে পারি, সেটি গুরুত্বপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, কোনো হঠকারিতাকে এ সরকার প্রশ্রয় দেবে। ঐক্যবদ্ধ থাকলে অপপ্রচার চললেও দেশ এগিয়ে যাবে। এই প্রজন্ম ডিজিটাল মিডিয়াতে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে। তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি। কোথাও কেউ নিপীড়িত হলে তার বিপরীতে সরকার গৃহীত ব্যবস্থার কথাও প্রচার করতে হবে। ঠেকায় পড়ে নয়, আমাদের সহজাত ঐক্য বজায় রাখার কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন বলে জানান তিনি।

This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!

Report

What do you think?

Written by Sultana

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

GIPHY App Key not set. Please check settings

Loading…

0

এতে চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে : জয়া!

গাজায় ফিলিস্তিনীদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে ইসরাইল