যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈঠক আজ যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক চূড়ান্ত না: অর্থ উপদেষ্টা ষ আমরা উদ্বিগ্ন, আরো সুনির্দিষ্ট এবং সিরিয়াস হওয়া উচিত- বিজিএমইএ সভাপতি :: বাংলাদেশের রফতানি খাতের জন্য বিপর্যয়কর হবে : রুবানা হক :: মার্কিন বাজার ছাড়াও অন্যান্য দেশের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি কমার শঙ্কা রয়েছে -ড. মোস্তাফিজুর রহমান :: এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বাড়তি সুবিধা পাবে-এমনটি আশা করা যৌক্তিক নয় -ড. মোস্তফা আবিদ খান!
মার্কিনীদের পরীক্ষিত বন্ধু ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অথচ অন্যান্য দেশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত শুল্ক আলোচনার মাধ্যমে কমানোয় সফল হলেও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার মার্কিনীদের মন গলাতে পারছে না। কেন পারছেন না এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্ক আরোপে বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে। শুল্ক কমাতে বাংলাদেশ সরকারের জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ৬২৬টি পণ্যে শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয় জাতীয় বাজেটে। এর মধ্যে ১১০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং আমেরিকা থেকে পণ্য আমদানি বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়। এসব বিষয়ে চুক্তি করতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছেন। আজ মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈঠক হবে। প্রশ্ন হচ্ছে বৈঠকে কি বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা মার্কিনীদের মন গলাতে পারবেন? ভিয়েতনামের মতো দেশ পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা।
এ প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেছেন, ৩৫ শতাংশ মার্কিন শুল্ক বহাল থাকলে বাংলাদেশের রফতানি খাতের জন্য বিপর্যয়কর হবে। সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কি নেগোসিয়েশন করছে, বা করেছে আমরা কিছুই জানি না। ভিয়েতনাম যখন ২০ শতাংশ শুল্কে পোশাক রফতানি করবে, তখন আমাদের দিতে হবে ৩৫ শতাংশ। আমরা এখনও নিশ্চিত না আগের যে ১৬ শতাংশ শুল্ক রয়েছে, সেটিও যুক্ত হবে কিনা। যদি সেটিও যুক্ত হয়, তাহলে তো পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। তবে এখনো সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়নি। যেহেতু আগস্ট মাস পর্যন্ত সময় পাচ্ছে বাংলাদেশ, ফলে এই সময়ের মধ্যে আলোচনা করে এই ট্যারিফ কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে। সরকারের নীতি নির্ধারকরা তো যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন কিংবা আছেন বলে জেনেছি। ফলে আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশী রফতানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকপণ্য রফতানিতে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এ হারে শুল্ক নিয়েও ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে ৭৩৪ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় বেশি ছিল। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অর্থমূল্য বিবেচনায় দেশটিতে বাংলাদেশের মোট রফতানির ৮৭ শতাংশই তৈরি পোশাক। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর গত ২ এপ্রিল শতাধিক দেশের ওপর চড়া হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের ওপর বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা আসে। যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) আরোপ হওয়ার পর বাংলাদেশ যত দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে ওয়াশিংটনে চিঠি পাঠিয়েছিল, শুল্ক কার্যকর তিন মাস স্থগিত করার পর বাংলাদেশের মধ্যে দরকষাকষির বিষয়ে ঢিলেঢালা ভার চলে আসে। তিন মাসের শুল্কবিরতি প্রায় শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে গত সোমবার বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতদিন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ, এখন নতুন করে আরও ৩৫ শতাংশ শুল্ক বাড়ায় এটি দাঁড়াবে ৫০ শতাংশে। যা কার্যকর হবে আগামী ১ আগস্ট থেকে। তাতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাবে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক খাত, কারণ যুক্তরাষ্ট্রই বাংলাদেশি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার।
এদিকে ট্রাম্প পারস্পরিক শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম সমস্ত মার্কিন পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে দরকষাকষি শুরু করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার ঘোষণার পর বাজেটে তা কার্যকর করেছে। কোন ১০০ পণ্যে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে চায়, যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে তখন তালিকা চাওয়া হলেও বাজেটের আগে সেই তালিকা সরবরাহ করেনি ঢাকা। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বাংলাদেশের পক্ষে দরকষাকষিতে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান সেখানে অবস্থান করছিলেন। ওই সময় ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বার্তা পাঠিয়ে দরকষাকষির বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়।
২৬ জুন ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের (ইউএসটিআর) সঙ্গে মিটিংয়ের আগে তিনি সরকারকে আভাস দেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে বাংলাদেশ সবচেয়ে এগিয়ে আছে। যদিও ভিয়েতনামসহ কোনো দেশের পক্ষেই ৯ জুলাইয়ের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছা সম্ভব নয়। তবে ট্রাম্পের বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণার পরেও ১ আগস্ট থেকে নতুন শুল্ক কার্যকর করার কথা বলা হলেও আলোচনার দরজা খোলা রেখেছে ওয়াশিংটন। এ সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক চূড়ান্ত নয়; বুধবারের সভায় ওয়ান টু ওয়ান নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এটা ঠিক হবে। মিটিংয়ের পর আমরা বুঝতে পারবো। কারণ, যেটা দিয়েছে, সেটা ঠিক অফিসিয়াল। মিটিংয়ে কি কোনো উন্নতি হওয়ার আশা করা যায়? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, আমরা আশা করি। যাই হোক, সেটার পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য পদক্ষেপগুলো নেবো। এদিকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আজ বুধবার আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বর্তমানে আলোচনায় অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। এক বিবৃতিতে শেখ বশিরউদ্দীন জানান, এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠক রয়েছে। সেখানে ভালো কিছুর আশা করছে বাংলাদেশ।
অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকদের মতে, বাড়তি শুল্ক আরোপের কারণে বিদেশি ক্রেতারা শিগ্গিরই দেশীয় রফতানি পণ্যের দাম কমানোর চাপ দিতে পারে। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ক্রেতার চাহিদা হ্রাস পাবে। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসার খরচ কমিয়ে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এছাড়া তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা হ্রাস, বিকল্প বাজার সন্ধানসহ ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে সংস্কার করে আঞ্চলিক বাজারের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র জানায়, ওয়াশিংটন থেকে সরকার আরেকটি বার্তা পায়, যেখানে বলা হয়, ৩-৪ জুলাইয়ের দিকে ট্রাম্প প্রশাসন পারস্পরিক শুল্ক কার্যকর করার সময়সীমা এক বছর পর্যন্ত পিছিয়ে দিতে পারে। তাই দরকষাকষি চূড়ান্ত করে ৯ জুলাইয়ের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশের আটকে পড়া ঠিক হবে না। এ কারণেই আলোচনায় ধীর গতিতে এগোনোর কৌশল নেয় ঢাকা।
আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আকর্ষণীয় কোনো প্রস্তাব ঢাকার পক্ষ থেকে উপস্থাপন না করে দেশটি বাংলাদেশের কাছে কোন কোন পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা চায়, তার একটি তালিকা চায় ঢাকা। গত সোমবার রাতে বাংলাদেশের ওপর প্রস্তাবিত শুল্কহার ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়া চিঠির সঙ্গে সেই তালিকাসহ নতুন করে চুক্তির ডকুমেন্ট পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সর্বশেষ মিটিংয়ে ঢাকা অনুরোধ করে, ৯ জুলাইয়ের মধ্যে চুক্তি সম্পন্ন না হলে যেন প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ হারে শুল্কারোপ না হয় বাংলাদেশের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না জানিয়ে বলা হয়, ইট মে বি নট, যেহেতু তোমরা নেগোসিয়েশনের মধ্যে আছ।
গত ৩ জুলাইয়ের মিটিংয়ে বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব তুলে ধরে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ইউএসটিআর কর্মকর্তারা বিবেচনার আশ্বাস দিলে বাংলাদেশ মনে করে, এলডিসিগুলোর জন্য শুল্কহার কম হবে। যেহেতু ভিয়েতনাম উন্নয়নশীল দেশ এবং বাংলাদেশ এলডিসি, তাই স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের শুল্কহার ভিয়েতনামের চেয়ে কম হবে।
বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্কের ফলে কোটি কোটি ডলারের তৈরি পোশাকের বিদেশি ক্রয়াদেশ বাতিল হতে পারে, বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য এখনো সময় আছে, বলছেন অর্থনীতিবিদরা। এদিকে, আজ বুধবার মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিতীয় দফার বৈঠকে শুল্ক নিয়ে ভালো খবার পাওয়ার আশা করছেন অর্থ উপদেষ্টা ।
তবে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই এলডিসিগুলোর জন্য বাড়তি কোনো সুবিধা দেয়নি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এলডিসি হওয়া সত্ত্বেও এই দুই দেশের উপর প্রস্তাবিত রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ রেট ভিয়েতনাম, চীন, ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। তাই এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বাড়তি সুবিধা পাবে-এমনটি আশা করা যৌক্তিক নয়।
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কারোপের চিত্রে দেখা যায়, ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ, মিয়ানমার ও লাওসের ওপর ৪০ শতাংশ, মালয়েশিয়া ও তিউনিসিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ শতাংশ, এবং কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের ওপর ৩৬ শতাংশ করে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন-ঘনিষ্ঠ লবিষ্ট ফার্ম নিয়োগ দিতে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ চেম্বার অভ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ। কিন্তু সরকার সে ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে জানান তিনি। বিজিএমইএর সাবেক এই সভাপতি বলেন, ইউএসটিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ট্যারিফ কমানো বা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া যাবে না। এজন্য আমরা লবিস্ট নিয়োগ দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছিলাম।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে সফল হতে না পারার আরেকটি কারণ হলো, প্রস্তাবিত পারস্পরিক শুল্ক চুক্তিতে ওয়াশিংটন এমন কিছু শর্তারোপ করেছে, যা প্রচলিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্র্যাকটিস ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেসব বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়, তাতে ২৬ জুনের সভায় রাজি হয়নি ইউএসটিআর।
গত ৩ জুলাইয়ের মিটিংয়েও বাংলাদেশ জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শর্তগুলো পালন করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) নিয়মের মধ্যে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে চায় বাংলাদেশ। এ কথা বলার পরও যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তীতে বৈঠক করার ক্ষেত্রে সম্মতি দিয়েছে, তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ধরে নিয়েছেন যে বাংলাদেশের প্রস্তাবে ইউএসটিআর রাজি হয়েছে।
২ এপ্রিল শুল্ক আরোপের প্রস্তাবের পর ৯ এপ্রিল ইউএসটিআরের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এরপর ২১ এপ্রিল ওয়াশিংটনে ইউএসটিআরের সঙ্গে এ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়। ওই সময় ইউএসটিআর ৬টি পয়েন্টে আলোচনার বিষয়ে সম্মত হয়।
পরবর্তীতে ৪ জুন ফের ইউএসটিআরকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। পারস্পরিক শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১২ জুন একটি নন-ডিসক্লোজার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ, যার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক শুল্ক চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয় বাংলাদেশ।
গত ১৭ জুন অনুষ্ঠিত অনলাইন মিটিংয়ে দুই দেশের মধে পারস্পরিক শুল্ক চুক্তি করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঢাকা। পরে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তির একটি খসড়া বাংলাদেশকে পাঠিয়েছে, যা নিয়ে এখনও দরকষাকষি চলছে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত পারস্পরিক শুল্ক চুক্তিতে এমন শর্ত দেওয়া হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বাংলাদেশকেও ওই দেশের উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করলে বাংলাদেশকেও তা অনুসরণ করতে হবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন একটি শর্তারোপ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ছাড় দেবে, একই পণ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশকে ছাড় দেওয়া যাবে না। এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মোস্ট-ফেভার্ড ন্যাশন (এমএফএন) নীতির বিরোধী।
যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে দেশটি থেকে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। এরই অংশ হিসেবে সরকারিভাবে বোয়িং উড়োজাহাজ, এলএনজি, গম আমদানি বাড়ানো হচ্ছে।
গত সপ্তাহে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান বাবু বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এই উদ্বেগ থেকেই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মিটিং করেছি। তিনি আমাদের পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, আমাদের আরও সুনির্দিষ্ট, আরও সিরিয়াস হওয়া উচিত।
এদিকে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান যুক্তরাষ্ট্র সময় ৮ তারিখ ও বাংলাদেশ সময় ৯ তারিখ সকালে পরবর্তী মিটিং হবে। তিনি বলেন, চুক্তি স্বক্ষর নিয়ে আলোচনা চলাকালে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে আমাদের চিঠি দেওয়া হতাশাজনক। একই সঙ্গে তারা একটি নতুন চুক্তির খসড়াও পাঠিয়েছে। এটি বেশ বড় একটি নথি, যা এখনো সম্পূর্ণরূপে পর্যালোচনা করা হয়নি।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালাগরে (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ শতাংশ শুল্ক বসাবে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর। যেখানে প্রধান প্রতিদ্বন্দী দেশ ভিয়েতনামের উপর মাত্র ২০ শতাংশ। যে কোনো বিচারেই এটি বড় মাত্রার আমদানি শুল্ক, যা পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেবে। যেহেতু আমাদের মোট পোশাক রফতানির ৯০ শতাংশ যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। এতে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য বাংলাদেশি রফতানি পণ্য কেনা কমিয়ে দেবেন সে দেশের ক্রেতারা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের রফতানির ওপর। একই সঙ্গে মার্কিন বাজার ছাড়াও অন্যান্য দেশের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি কমারও শঙ্কা রয়েছে।
উল্লেখ্য, ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর গত ২ এপ্রিল শতাধিক দেশের ওপর চড়া হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের ওপর বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা আসে। এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে সম্পূরক শুল্ক পুনর্বিবেচনা করতে ডনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি পাঠান বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত তিন মাস স্থগিত রাখার অনুরোধ করা হয় সেখানে। এই তিন মাস সময় ট্রাম্প মূলত দিয়েছিলেন আলোচনার জন্য। বাংলাদেশের তরফ থেকেও সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। ৩৭ শতাংশের বদলে ট্রাম্প এবার ৩৫ শতাংশ শুল্কের খড়গ নামিয়েছেন বাংলাদেশের ওপর। চূড়ান্ত শুল্কের পরিমাণ উল্লেখ করে বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের নেতাদের উদ্দেশ্যে সোমবার চিঠি পাঠান ট্রাম্প। এসব চিঠি ট্রুথ সোশ্যালে প্রকাশ করা হয়েছে।
This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!
GIPHY App Key not set. Please check settings