in ,

বাংলাদেশি গাড়ি ডিজাইনার

বাংলাদেশেই জন্ম, বাংলাদেশি এমন অনেক তরুণ আছেন, যারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের কাজের জন্য সমাদৃত হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন। তেমনই একজন নিজামুদ্দিন আউলিয়া। নামটা অনেকের কাছেই অপরিচিত লাগতে পারে। তার ডাকনাম লিপু। ‘লিপু অ্যান্ড পিটবুল’ নামক একটি মার্কিন রিয়েলিটি শোর মাধ্যমে যাকে কমবেশি সব গাড়িপ্রেমীই এক নামে চেনেন।

লিপু অ্যান্ড পিটবুল রিয়েলিটি শো’র পোস্টারে লিপু। (বায়ে)

লিপু একজন গাড়ি অটোমোটিভ ইঞ্জিনিয়ার এবং ডিজাইনার। আপনি একটি পুরনো গাড়ি তার হাতে তুলে দিলে, সে গাড়িটিকে রিডিজাইন করে এমন একটি রূপ দান করবেন যে, নিজেই নিজের গাড়িকে চিনতে পারবেন না। পুরনো গাড়িকে অত্যাধুনিক রূপ দান করার বেলায় লিপুর জুড়ি নেই। আর এজন্যই সে আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত হয়েছেন। কাজ করেছেন বড়বড় গাড়ি ডিজাইনার এবং ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে।

লিপুর জন্ম বাংলাদেশেই ১৯৬৮ সালে। ঢাকার ছেলে লিপু ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলে। কিন্তু এরপরই তিনি বাবার চাকরির সুবাদে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান সৌদি আরবে। সেখানে ১৬ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো একটি মোটর শো’তে ঘুরতে গিয়েছিলেন। সেদিন চোখ ধাঁধানো সব গাড়ি দেখে তার চিন্তা আর স্বপ্নে শুধু গাড়ি আর গাড়ি। সেদিন তাকে সবচাইতে বেশি আকৃষ্ট করেছিল ফেরারি গাড়ি এবং দুর্দান্ত সব রেসিং গাড়িগুলো। মনে মনে ভাবতে লাগলেন নিজের যদি এমন একটা গাড়ি থাকতো!  কিন্তু সেসময় তার এত দামী গাড়ি কেনার সামর্থ্য ছিল না। তাই অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গাড়ি ডিজাইনিং এর স্বপ্ন সেই কৈশোর বয়স থেকেই লালন করেছিলেন তিনি। নিজের গাড়ি নিজেই বানাবেন আর ডিজাইন করবেন এই দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অটল থেকেছেন। স্বপ্ন দেখেছেন একটা ল্যাম্বারগিনি বানাবেন।

নিজ ওয়ার্কশপে লিপু।

লিপুর ল্যাম্বরগিনির স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। একটা সিডান গাড়িকে ভেঙ্গে নিজের মতো করে বানিয়েছিলেন ল্যাম্বরগিনি ক্রাউন্টেশ। কিন্তু গাড়িটির নামকরণ করেছিলেন লিম-বিল। তখনো অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে তার জ্ঞান ততটা শক্ত হয়নি। কিন্তু নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে ঠিকই ধারণা পেয়েছিলেন। তাই স্বপ্ন দেখতে লাগলেন বানাবেন বাংলাদেশি লিমুজিন! কোন অটো মেকানিজম না জেনে, একটা ল্যাম্বারগিনির পোস্টার দেখেই যিনি ল্যাম্বরগিনি গাড়ির মডেল দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারেন। তার পক্ষেই এমন স্বপ্ন দেখা সম্ভব।

২০০০ সালের কথা। ঢাকায় ফিরে তিনি নিজের ব্যবসা শুরু করেন। কয়েকটি পুরনো গাড়ি জোড়া দিয়ে নিজের ডিজাইনে তৈরি করলেন লিমুজিন। ২.৮ লিটার ডিজেল ইঞ্জিনের সাহায্যে, মাত্র ৪০ দিন সময় নিয়ে এই গাড়িটি বানাতে তাকে সহায়তা করেছেন তার ছোটভাই দিপু। তার বানানো ২৮০০ সিসির লিমুজিনটি দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি লিমুজিন গাড়ির বিলাসবহুল বৈশিষ্টও ছিল নজরকাড়া। ইন্টারকম, টিভি, পানি রাখার ক্যাবিনেট সহ গাড়িটি বানিয়েছিলেন। ঢাকার রাস্তায় তার লিমুজিন দেখে মানুষের কপালে চোখ উঠে যেত!

লিপুর লিমুজিন

লিপু তার জিগাতলার বাসার গ্যারেজেই গাড়ি নিয়ে কাজ করতেন। লিমুজিন বানাবার পর তিনি ফিরে যান তার প্রথম প্রেম ফেরারির কাছে। ২০০২ সালের শেষ দিকে চারজন মেকানিককে সাথে নিয়ে শুরু করেন ফেরারি তৈরি কাজ। মূল ফেরারির ডিজাইন থেকে শুধুমাত্র একজোড়া লাইট এবং মনোগ্রামগুলো ধার করেছিলেন। বাদবাকি সমস্ত ডিজাইন ছিল তার করা। তিনি এই গাড়িটি বানাতে যে ধাতব শিট ব্যবহার করেছিলেন সেগুলো মূলত ঢাকায় চলিত রিকশায় ব্যবহৃত হয়। গাড়িটির নাম দেন ‘স্বাধীনতা-৭১’!

মূলত স্বাধীনতা -৭১ বানাবার পরেই তার ভাগ্যের মোড় ঘুরে যায়। ২০০৩ সালে বিবিসিতে তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনের পরই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন লিপু। ফেরারি ওনার্স ক্লাবের মূল ওয়েবসাইটে স্থান দেয়া হয় তাকে। সেখানে তার গাড়িকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় দ্যা বাংলাদেশ ফেরারি হিসেবে।

অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এ উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পাড়ি জমান আমেরিকায়। মিশিগানের জেনারেল মোটরস ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু পুথিগত বিদ্যায় বিরক্ত হয়ে পড়াশোনাই ছেড়ে দেন। আবার ফিরে আসেন বাংলাদেশে। পুনরায় শুরু করেন নিজের ওয়ার্কশপ। টানা তিন বছর তিনি এই ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেন। তিনি মূলত মানুষের পছন্দমাফিক গাড়ি বানিয়ে দিতেন। মূলত কাস্টমাইজ গাড়ি তৈরিই ছিল তার ওয়ার্কশপের প্রধান কাজ। ইতোমধ্যে ফ্রান্সেও বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি। ২০০৪ সালে ফ্রান্সের ইন্টারসেকশন পত্রিকায় তাকে নিয়ে প্রতিবেদন করা হয়েছিল।

২০০৬ সালে ঢাকা মোটর শো তে তার বানানো গাড়ি এম২৬ প্রদর্শিত হয়েছিল। গাড়িটির ডিজাইন এতটাই আধুনিক ছিল যে, কেউ একবারের জন্যও ভাবতে পারেনি গাড়িটি ২২ বছরের পুরোনো টয়টা স্প্রিন্টারকে ভেঙ্গে বানানো হয়েছিল। এর পরই বানান ‘দ্যা পিস কার’। তিনি এই গাড়িটি বানিয়েছিলেন পুরোনো একটি টয়টা ক্রাউন গাড়িকে মডিফাই করে। এই গাড়িটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে স্থান পেয়েছে।

লিপুর হাতের জাদুতে একটা নষ্ট গাড়ি পরিণত হয় সুপারকারে।

সেবছরই যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে মাইগ্রেশনের জন্য আমন্ত্রন জানায়। সেখানে তিনি কার ট্রান্সফরমেশন প্রকল্পের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। এই প্রকল্পে একটি ফোর্ড গাড়িকে নিজের সৃজনশীলতা এবং দক্ষতায়  আরো স্টাইলিশ ডিজাইনে রূপান্তর করেছিলেন। গাড়িটির নাম দিয়েছিল ‘কার’ । এই গাড়িতি নিয়ে পরে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি এই গাড়িটি লন্ডনের রিচ মিক্স সেন্টারেও প্রদর্শিত হয়েছিল।

এরপরই তিনি চলে আসেন ডিসকভারি চ্যানেলের পর্দায়। ‘বাংলা ব্য্যঙ্গারস’ নামের এই অনুষ্ঠানে ঢাকায় কাস্টমাইজ গাড়ি তৈরি নিয়ে ফিচার করা হয়েছিল লিপু এবং বার্নি ফাইনম্যানকে। এই অনুষ্ঠানে দেখানো হয় কীভাবে লিপু আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই স্টাইলিশ গাড়ি নির্মাণ করেন। ডিসকভারি থেকে তাকে ৮ সপ্তাহ সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল দুটি গাড়ি বানানোর জন্য। বার্নি ফাইনম্যানকে সঙ্গী করে তিনি ৩ সপ্তাহের মধ্যেই গাড়িগুলো বানিয়ে দেখিয়েছিলেন।

২০০৭ সালে লিপু দ্যা এঞ্জেল কার নামের একটি গাড়ি তৈরি করেছিলেন। গাড়িটি লন্ডনের ব্রিক লেনের বৈশাখী মেলায় প্রদর্শিত হয়েছিল।

ঢাকার রাস্তায় লিপুর বানানো ল্যাম্বারগিনি।

বাংলা ব্যাঙ্গারস অনুষ্ঠানের সিকুয়্যাল দ্যা চপ শপ লন্ডন গ্যারেজেও উপস্থিত ছিলেন লিপু এবং বার্নি ফাইনম্যান।এই অনুষ্ঠানে তারা দুইজন নামকড়া সব সেলিব্রেটিদের গাড়ি কাস্টমাইজ করে দেয়ার একটি রিয়েলিটি শো করতেন। এই রিয়েলিটি শোর মূল চ্যালেঞ্জ ছিল ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুসারে কম খরচে কাস্টমাইজ গাড়ি প্রস্তুত করে দেয়া।

লিপু যে শুধু নিজের জন্য বা সেলিব্রেটিদের জন্য গাড়ি তৈরি করেন তা নয়। সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেও তিনি অনেক গাড়ি তৈরি করেছেন। ২০১১ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে  তৈরি করেন ‘সুরুজ’ নামের একটি গাড়ি। তার দাদার নামে গাড়িটির নামকরণ করেছিলেন। গ্যাস, তেল এমনকি বিদ্যুতেও চলবে এই গাড়ি। আর দাম পড়বে মাত্র আড়াই লক্ষ টাকা।

২০১৫ সালে তিনি আবার হাজির হন হিস্টোরি চ্যানেলে। বিশ্ব দেখে এক বাংলাদেশী গাড়ি জাদুকরকে। যার হাতের ছোঁয়ায় পুরনো ভাঙ্গাচোরা গাড়িও হয়ে অত্যাধুনিক সুপার কার! হিস্টোরি চ্যানেলে স্টিভ পিটবুলের ট্রিম্বলির গ্যারেজ নিয়ে লিপু অ্যান্ড পিটবুল নামে একটি রিয়েলিটি শো অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পিটবুলের সাথে ছিলেন বাংলাদেশি লিপু। এই অনুষ্ঠানে তারা দেখাতেন কীভাবে পরিত্যাক্ত গাড়ি সুপারকারে রূপান্তর করা যায়। যা আবার বাণিজ্যিকভাবে বিক্রিও করা হয়!

ডিসকভারি চ্যানেলে লিপু।

নিজ একাগ্রতা এবং ধৈর্য কে পুঁজি করে তিনি বিশ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার এই অভাবনীয় কৃতিত্বর সম্মানস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র তাকে সর্বোচ্চ অভিবাসন সুবিধা দিয়েছে। তিনি এখন সেখানের লং আইল্যান্ড সিটিতে তার স্ত্রী এবং তিন সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছেন এবং বিশ্বের গাড়ি শিল্পে নিজের অবদান রেখে চলেছেন।

নিজের ইচ্ছাশিক্তি যে মানুষকে কতটা উপরে নিয়ে যেতে পারে লিপুই তার অনন্য উদাহরণ। কাস্টমাইজ গাড়ি তৈরিতে তার যে নৈপুণ্য, তা লিপুর কথাতেই ফুটে ওঠে। তিনি বলেছিলেন,

রূপকথার গল্পে সিন্ডারেলার গডমাদার সিন্ডারেলাকে বল ড্যান্সে যাওয়ার জন্য যেভাবে একটি কুমড়ো থেকে আস্ত একটা গাড়ি বানিয়ে দিয়েছিলেন, আমিও সেরকমই। যত পুরনো গাড়িই হোক না কেন, তাকে আধুনিক রূপদান করাই আমার কাজ”

নিজের ডিজাইন করা গাড়ির সামনে লিপু।

বাংলাদেশে এখনও গাড়ি প্রস্তুত শিল্প সেভাবে গড়ে ওঠেনি। কাঠামোগত কারণে পিছিয়ে থাকলেও বাংলাদেশি গাড়ির জাদুকর লিপু বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়ত রূপকথার মতই বেঁচে থাকবেন!

Report

What do you think?

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

GIPHY App Key not set. Please check settings

Loading…

0

কিছু মজার তথ্য

[draft]