বিশ্ব রাজনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত নাম গাম্বিয়া। আফ্রিকার মানচিত্রে যে দেশটি কে খুঁজে পেতে গেলে মিনিটখানেক চেষ্টা করতে হয় সে গাম্বিয়া আজ কাঁপিয়ে দিয়েছে মিয়ানমার এর সামরিক জনতা ও সরকারের। আমেরিকা, চীন, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব কিংবা তুরস্কের মত প্রভাবশালী দেশগুলো রোহিঙ্গা নির্যাতনের ইস্যুতে চুপ ছিল। নজর ফিরিয়ে নিয়েছিল অন্যদিকে। সেখানে পুচকি একটা দেশ হয়েও গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক মামলা করেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে দেশ ছোট হলেই মানুষগুলোর কলিজা ছোট হবে এমন কোনো কথা নেই। আমাদের আজকের আয়োজন সেই গাম্ভীর কিছু চমকপ্রদ ব্যাপার নিয়েই।
মুসলিম দরদী দেশ, নাম গাম্বিয়া। এদেশের মানুষ সম্পর্কে জানতে হলে পড়লে হবে পুরো কন্টেক্টটি। গাম্বিয়া নামে দেশটা কোথায় এই প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে হয়রানি হতে হবে স্বয়ং আফ্রিকা মহাদেশের। সেনেগানের পেটের ভিতর ছোট্ট একটা সরু রেখার মত ছোট্ট একটা দেশ গাম্বিয়া। আর সে দেশের বুক চিরে বয়ে চলেছে গাম্বিয়ার নদী। আর এই নদীর দুই পাশের নিচু জমিতে গড়ে উঠেছে জনবসতি। গাম্বিয়ার নাগরিক যারা তাদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন সুদানের দক্ষিণাঞ্চল পঙ্গু এবং নাইজেরিয়া থেকে আটশো বছর আগে। গহীন জঙ্গলে ঢাকা ছিল আজকের গাম্বিয়া। ছিল বন্য জীব জন্তুর অভয়ারণ্য। আটলান্টিক এর মোহনা থেকে গাম্বিয়ার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে এলাকাটাকে আবিষ্কার করেছিল ইউরোপীয় পর্যটকরা। এই পথ ধরে গঙ্গার বুকে স্বর্ণের খোঁজে অভিযান চালিয়েছে অনেকেই। প্রথমে ফরাসিরা এসেছে, তারপর ইংরেজরা দখল করেছে দেশটাকে। ইতমধ্যে আমরা সবাই ই জেনে গিয়েছি যে গাম্বিয়া একটি মুসলিম দেশ। এর শতকরা ছিয়ানব্বই জনই মুসলমান। বাকিদের মধ্যে বেশিরভাগই খ্রিস্টান। আয়তনে গাম্বিয়া বাংলাদেশের দশ ভাগের এক ভাগও নয়। আরো স্পষ্ট করে বললে আয়তনের দিক থেকে গাম্বিয়া আসলে আমাদের সিলেট বিভাগের থেকেও ছোট আর রাঙামাটি জেলার চেয়ে একটু বড়।
উনিশশো পঁয়ষট্টি সালে ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিলো গাম্ভীয়া। আর সেই থেকে উনিশশো চুরানব্বই সাল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা অটুট ছিল। উনিশশো চুরানব্বই সালে সেখানের প্রেসিডেন্ট যাওয়ার আগে রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে। প্রেসিডেন্টের পদও দখল করেন ঊনত্রিশ বছরের বয়স্ক সেনা কর্মকর্তা ইয়াহিয়া। গাম্বিয়ার ইতিহাসের একটা কালো অধ্যায় ছিল সেটা দারিদ্রতায় ভরপুর। একটা কৃষিকাজ ছাড়া এখানকার অধিবাসীদের করার তেমন কিছুই নেই। বেশিরভাগ মানুষই দিন আনে দিন খায়। তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো একনায়কতন্ত্র। প্রান্তিক সেনা শাসন রাজনীতিবিদেরা গেল জেলে। দেশ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর্মি অফিসাররা। বিপক্ষ দলের রাজনীতিবিদদের উপর নেমে হলো অত্যাচারের স্টিম রোলার। একটা সময়ের পরে সেই নির্যাতনের শিকার হল সংখ্যালঘু খ্রিস্টানরাও। লোক দেখানো কিছু নির্বাচন হয়েছে এর মধ্যেও। কিন্তু সেগুলোতেও ঘটেছে ব্যাপক ম্যানিপুলেশন।
গাম্বিয়ার মানুষের মধ্যে শিক্ষার হার টা তুলনামূলক কম। তাদের মনে সাম্প্রদায়িক একটা সহিংসতার বীজ ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। যারা এসবের প্রতিবাদ করেছে তাদের চিড়ে ফেলেছে ইয়াহিয়া সরকার। সাংবাদিক ছাত্র নেতা সহ অনেকেই গত একযুগে গাম্বিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়ে দু হাজার সতেরো সালে জনগণ এসবের জবাব দিল ব্যালটের মাধ্যমে। নির্বাচনে হেরে গেলেন স্বৈরশাসক। অবসান হলো বাইশ বছরের স্বৈরশাসনের। ফিরে এলো গণতন্ত্র। ক্ষমতায় বসলে নতুন প্রেসিডেন্ট আদা মা বেরো।
গত দুই বছরে গাম্বিয়ার অবস্থা আগের থেকে ভালো হয়েছে। যদিও অর্থনৈতিকভাবে এখনো তারা দুর্বল। দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে বেশিরভাগ মানুষ। কৃষি কাজটাই গ্রাম বিহার লোকজনের প্রধান পেশা। বাদাম উৎপাদন আর রফতানি করে তাদের বৈদেশিক আয়ের একটা অংশ আসে। পকেটে টাকা না থাকতে পারে, দেশটা ছোট্ট হতে পারে, কিন্তু হৃদয়ে মানুষের জন্য মায়ার অভাব নেই গাম্বিয়ার নাগরিকদের। আর তাইতো হাজার মাইল দূরে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের প্রতিবাদে তারা মামলা করেছে আন্তর্জাতিক আদালতে। আর সেই মামলা সামলাতে গিয়ে এখন কালো ঘাম ছুটে যাচ্ছে মিয়ানমারের। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মিয়ানমারের নেত্রী আংসান সূচি সৈন্য সামন্ত নিয়ে ছুটে গেছেন নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে। সুচির মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেছে। এই কাজটা করেছে আর কোনো দেশ নয়, একমাত্র ছোট গাম্বিয়া। মামলার পুরো প্রক্রিয়াটা সাজিয়েছে গাম্বিয়া। আর সেখানকার বিচার মন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই দুটো মানুষের কাছে বিশ্ববাসীর চিরঋণি হয়ে থাকবে।
ছোট্ট একটা অল্প জায়গায় অনেকগুলো মানুষ বাস করে। প্রাকৃতিক কোনো সম্পদ নেই। দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে মানুষ। তবুও তারা জানিয়েছে রোহিঙ্গারা যদি রাজি হয় তাহলে কিছু রোহিঙ্গা কে তারা নিজেদের দেশে আশ্রয় দিতে পারে। আমেরিকা যখন মেক্সিকো সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে, লাখ লাখ মানুষ কে দেশছাড়া করার মিশন হাতে নিয়েছে ভারত সরকার, শরনার্থীদের ঢল সামলাতে ইউরোপ যখন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা করেছে, সেই অমানবিকতার সময়টাই গাম্ভীর এমন মানবতাবোধ আমাদের সত্যিই ভীষণ আপ্লুত করে।
This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!
GIPHY App Key not set. Please check settings