সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেরই ভালোবাসাময় ছবি দেখা যায় নিয়মিত। আজ এখানে তো কাল সেখানে। অথচ ঘরের মধ্যে তারাই অাবার একজন আরেকজনের চোখের কাঁটা। আসলে বেশির ভাগ মানুষ নিজের যাপিত জীবনের ভালোটাই দেখাতে চায় ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কষ্টটাকে সামনে আনতে চায় না অনেকে!
এখন সবাইকে বলতে শুনি যে ‘মানুষ ফেসবুকে শুধু নিজের ভালোটাই দেখায়।’ এ কথা শুনে আমার মনে হয়, সমস্যা কোথায়? ফেসবুক একটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ফেসবুকের আগে সামাজিক মাধ্যম বলতে আমরা বিভিন্ন দাওয়াত, মজলিস, আড্ডা বুঝতাম।
মনে করেন, আপনি একটা দাওয়াতে যাচ্ছেন। সেখানে অনেক মানুষ। তাঁর মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই আপনার খুব বেশি ঘনিষ্ঠ নন। এ রকম জায়গায় গিয়ে তো আপনি সবাইকে ডেকে নিজের জীবনের সব দুঃখের কথা বলবেন না। হাস্যোজ্জ্বল থাকার চেষ্টা করবেন। নিজেকে যতটা ভালোভাবে প্রদর্শন করা যায় মানুষের সামনে, সেই চেষ্টাই করবেন। খুব বেশি নেতিবাচক আলোচনা বা আচরণ থেকে বিরত থাকবেন।
মানুষের কাছে এখন ফেসবুক একটা দাওয়াত বা মিলনমেলার মতো। মানুষ যে রকম দাওয়াতে একটু সেজেগুজে যায়, ফেসবুকেও নিজের জীবনের ভালো দিকগুলোই বেশি দেখাতে পছন্দ করে। এতে আমি দোষের কিছু দেখি না।
সামাজিক মাধ্যমকে সামাজিকতার জায়গায় রাখাটাই মনে হয় শ্রেয়। অবশ্য এটা বলা যত সহজ, করা ততটা সহজ নয়। বিভিন্ন ডিজিটাল সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক ক্রমশই আমাদের জীবনের একটা অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাণিজ্য থেকে বিনোদন—সবকিছুর সঙ্গেই ফেসবুক জড়িত। তারপরও আমার মনে হয়, আসল মানে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমের জীবনকে কোথাও একটা আলাদা করা জরুরি; বিশেষ করে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপারে।
ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেটা সবচেয়ে বেশি মনে রাখা প্রয়োজন সেটা হলো ফেসবুকে নিজেকে বা নিজের জীবনকে প্রকাশ করার ব্যাপারে সবাই একই মাত্রায় স্বচ্ছন্দবোধ করেন না। অনেকেই আছেন যাঁরা নিজের জীবনের সব তথ্য এবং মতামত সহজেই ফেসবুকে প্রকাশ করে ফেলেন। আবার অনেকে ব্যক্তিগত বিষয় শেয়ার করার ব্যাপারে একদমই অপ্রতিভ। আমার বিশ্বাস, দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষের সংখ্যাই বেশি। এ ছাড়া ফেসবুকের অ্যালগরিদম এখন এমন যে কারও সঙ্গে ফেসবুকে সংযুক্ত থাকলেও তাঁদের সিংহভাগ পোস্ট আমাদের চোখে পড়ে না।
ভেবে দেখুন, কতবার এ রকম হয়েছে যে আপনি এমন শুনেছেন, কেউ খুব খারাপ সময় কাটাচ্ছে। তখন আপনার মনে হয়েছে—কেন, কিছুদিন আগেই তো ফেসবুকে ওর একটা মজার পোস্ট দেখলাম। পরে ফেসবুকে তাঁর প্রোফাইলে গিয়ে দেখলেন যে মজার পোস্টের পাশাপাশি অনেক পোস্টই হয়তো আছে, যেখানে সে সরাসরিভাবে অথবা আকার–ইঙ্গিতে নিজের দুঃখের কথা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নিজের দুঃখ কোনোভাবেই প্রকাশ করেনি। আমার এ রকম অনেক হয়েছে। খুব কাছের মানুষের ক্ষেত্রেই হয়েছে।
অনেক সময় মনে করেছি, অমুক মানুষটা কেমন আছে? একটু ফোন দিই বা অন্তত মেসেজ পাঠাই। তারপর তাঁর ফেসবুক প্রোফাইল বা পোস্ট দেখে ভেবেছি ‘ভালোই তো আছে’। ফোন দেওয়া, মেসেজ পাঠানো বা দেখা করা হয়নি। কিছুদিন পড়ে জেনেছি সেই মানুষ ভালো নেই। অথবা খবর পেয়েছি হয়তো ফেসবুকেই—সেই মানুষটা চিরতরে চলে গেছে। তখন হাজার ফেসবুক পোস্ট দিয়ে বা পড়েও নিজের দুঃখ এবং আফসোস কাটাতে পারিনি।
ফেসবুকে কাউকে যুক্ত (অ্যাড) করার সঙ্গে সঙ্গেই সে আমাদের ফ্রেন্ড হয়ে যায়। এভাবে আমাদের সবারই এখন অনেক অনেক বন্ধু আছে। এদের মধ্যে হয়তো বেশির ভাগ মানুষকে আমরা তেমন ভালোভাবে চিনিও না। কিন্তু ফেসবুক কাছের ও দূরের মানুষের মধ্যে বৈষম্য করে না। ফেসবুকের চোখে ফ্রেন্ডলিস্টের সবাই আমাদের কম বেশি সমান পর্যায়ে বন্ধু। প্রতিদিন আমরা শত শত, কারও কারও ক্ষেত্রে হাজার হাজার বন্ধুর খবর পেতে থাকি। এই হাজার বন্ধুর ভিড়ে আমরা হয়তো আসল বন্ধুদের কথা ভুলে যাই। আসল বন্ধুকে ফোন দেওয়ার কথা ভেবেও তাকে ফোন দিই না। আরেক বন্ধুর পোস্ট চোখে পড়ে যায়। আরেক বন্ধুর সুখ–দুঃখ অথবা ক্রোধের খবরে আমরা মশগুল হয়ে পড়ি। অনেক বন্ধুর মাঝে আসল বন্ধু হারিয়ে যায়।
ফেসবুককে দোষ দিয়ে আসলে লাভ নাই। ওদের কাজ আমাদের জীবনে বন্ধু বাড়ানো। আসল বন্ধুর খবর রাখার দায়িত্ব আমাদের নিজেদেরই নিতে হবে। তাহলে কাছের মানুষ কাছে থাকবে। আর অচেনা মানুষের হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখে আমরা বিচলিত হব না
This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!
GIPHY App Key not set. Please check settings